নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়কের কোটি টাকার ৫ তলা বাড়ি
বাঁশখালী থানার পাশ দিয়ে একটি সড়ক চলে গেছে পৌর সদরের আশকরিয়া পাড়ার দিকে। সড়ক ধরে যেতে যেতে ‘জয়নালের বাড়ি কোনটি’ জানতে চাইতেই সবাই পথ দেখিয়ে দিলেন। জয়নাল আবেদীন এ পাড়ায় বেশ পরিচিত নাম। গ্রামীণ এই পাড়ার বেশির ভাগ ঘর কাঁচা বেড়ার। দু-একটি দোতলা বা তিনতলা পাকা ভবন রয়েছে। সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে এ পাড়ায় জয়নালের নির্মাণাধীন পাঁচতলা ভবনটি।
চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন (৩৫) কোটি টাকার এই বাড়ি নির্মাণে হাত দিয়েই এলাকায় খুব পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর গ্রেপ্তারের খবরও গ্রামের কমবেশি সবাই জানেন। নির্বাচন কার্যালয়ের ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অভিযোগে গত রোববার রাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। তাঁর বন্ধুর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ২০১৫ সালে নির্বাচন কার্যালয়ের খোয়া যাওয়া একটি ল্যাপটপ। গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে জয়নালকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশনে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ পাওয়া জয়নাল আবেদীনের এত উত্থানের পেছনে ছিল কমিশনের এই ল্যাপটপ। এটি ব্যবহার করেই তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। জয়নাল একা নন, এই চক্রের সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েকজন। নির্বাচন কমিশনের ঢাকাসহ বিভিন্ন অফিসে জয়নালের অন্তত ১০ স্বজন কর্মরত রয়েছেন। এলাকার অনেকের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পাঠাতেন জয়নাল ও তাঁর ভাই জসিম উদ্দিন চৌধুরী।
বাঁশখালী পৌর সদরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হারুন বলেন, নির্মাণাধীন বাড়িটি জয়নালের। কয়েক বছরেই কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ভোটার করে ভাইয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাঠান।
গত ১৮ আগস্ট স্মার্ট কার্ড তুলতে গিয়ে লাকী আকতার নামের এক রোহিঙ্গা নারী চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে ধরা পড়েন। এরপর তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এরপর থেকে কীভাবে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে রোহিঙ্গাদের ভুয়া এনআইডির তথ্য প্রদর্শিত হচ্ছে, তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। কমিশনের পাশাপাশি পুলিশ ও দুদকও তদন্তে নামে।
কোটি টাকার দালান
জয়নালদের পৈতৃক বাড়িটি আশকরিয়া পাড়ার ভেতরে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। ছোট ভাই জসিম উদ্দিন বিদেশফেরত। দুই বছর আগে জয়নাল তাঁদের পৈতৃক বাড়িটি পাকা করেন। সেখানেই মা-বাবা স্ত্রী ও ভাইকে নিয়ে থাকেন।
গতকাল দুপুরে জয়নালের পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তালা দেওয়া। এক প্রতিবেশী জানান, সকালে মা-বাবাসহ সবাই চম্পট দিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, বছরখানেক আগে আশকরিয়া মাজারসংলগ্ন এলাকায় সাড়ে তিন গন্ডার (৭ শতক) একটি প্লট কেনেন জয়নাল। গন্ডাপ্রতি ছয় লাখ টাকা দরে কেনা এই প্লটে ছয় মাস আগে পাঁচতলা বাড়ি তোলার কাজ শুরু করেন তিনি। এটি এখন গ্রামের সবচেয়ে বড় ভবন। গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়িটির চতুর্থ তলার ছাদ ঢালাই শেষ হয়েছে। রড সিমেন্ট ইট ভেতরে মজুত করা রয়েছে।
এ ছাড়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে জয়নাল চার গন্ডার আরেকটি প্লট কিনেছেন বলে জানা গেছে।
জয়নালের বাবা আবদুল মোনাফ একসময় মাছের ট্রলারের শ্রমিক ছিলেন।
একাধিক স্বজন কমিশনে
জয়নালের অন্তত ১০ স্বজন নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। জয়নালের মতোই ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে যোগ দেন তাঁর বোনের জামাই নূর আহমদ। রোববার দুদকের দলটি চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়ে এই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক জাফর সাদেক বলেন, তাঁদের অনেক স্বজন ঢাকাসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে কাজ করেন। এটা একটা চক্র। এই চক্রের সন্ধানে কাজ চলছে।
> নির্বাচন কার্যালয়ের ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অভিযোগে রোববার রাতে গ্রেপ্তার হন চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন। মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে জয়নালকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
জয়নালের খালাতো ভাই মো. মোজাফফর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে রয়েছেন। আরেক স্বজন মোহাম্মদ আলী রাঙামাটি জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে উচ্চমান সহকারী। আরেক স্বজন ওসমান গনি চৌধুরী রয়েছেন ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে। তাঁরা ২০০৪ সালে নিয়োগ পান।
জয়নালের বোনের জামাই নূর আহমদ বলেন, ‘জয়নালের কারণে আমাকে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমি এসবে জড়িত নই।’
আরও ৫১ ভুয়া এনআইডি
নির্বাচন কমিশনের তদন্ত দল সোমবার চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে ডবলমুরিং থানার পাঁচজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাঁদের মধ্যে জয়নালের মুঠোফোনে রোহিঙ্গা ভোটার-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে জয়নাল রোহিঙ্গাদের ভোটার করার বিষয়টি স্বীকার করেন। এরপর তাঁর বন্ধু বিজয় দাসের কাছ থেকে খোয়া যাওয়া একটি ল্যাপটপও উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় বিজয় দাস ও তাঁর স্বজন সুমাইয়া আকতারকে।
নির্বাচন কমিশনের তদন্ত দলের প্রধান উপপরিচালক ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপ থেকে অনেক তথ্য তারা মুছে দিয়েছে। এরপরও কিছু সঠিক এনআইডির পাশাপাশি ৫১টি ভুয়া এনআইডি পাওয়া গেছে। এই ৫১টি রোহিঙ্গাদের বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে।
এত দিন কেন চুপ ছিল কমিশন
২০১৪ ও ২০১৫ সালে দুটি ল্যাপটপ খোয়া যায়। কিন্তু খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ দুটি এত দিন পর্যন্ত কার্যকর ছিল, যার কারণে কমিশনের মডেম ও ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যেত।
তদন্ত দলের সদস্য টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, দুটি ল্যাপটপ থেকে বেআইনিভাবে ভুয়া এনআইডি করা হতো। বাকি ল্যাপটপটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
৫০ হাজার টাকায় এনআইডি
আটক তিনজনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় সোমবার রাতে মামলা করেন ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা। গ্রেপ্তারকৃত তিনজন ছাড়া সাগর (৩৭) ও সত্য সুন্দর দে (৩৮) নামের দুজনকে আসামি করা হয়। এই দুজন ২০০৭ সালে ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের এনআইডি সার্ভারে তথ্য আপলোডের কাজ করতেন।
কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, সাগর এনআইডি সার্ভারে তথ্য আপলোড করতেন। তাঁর কাছে দেশের সব উপজেলার এনআইডি আপলোডের পাসওয়ার্ড আছে। বর্তমানে তিনি বিআরটিএতে কর্মরত। সত্য সুন্দর ডেটা এন্ট্রি এক্সপার্ট। ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় একটি এনআইডি করে দিতেন। মামলাটি কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্ত করছে বলে জানান ওসি মহসীন।