হাসপাতালের নথিতে আবদুর রহমান 'অজানা' রোগী
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ফরমে নামের ঘরে লেখা ‘অজানা’। অর্থাৎ এই রোগীর পরিচয় জানা যায়নি বা কোনো স্বজন নেই। তবে ৭০ বছরের বেশি বয়সী রোগী নিজেই ক্ষীণ কণ্ঠে জানালেন তাঁর নাম আবদুর রহমান। দুই ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের নাম আমেনা, তা মনে করতে পারছেন। তবে অন্য সন্তানদের নাম মনে আসছে না। ঢাকার সেগুনবাগিচায় থাকতেন, এতটুকু মনে থাকলেও পুরো ঠিকানা বলতে পারছেন না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের এক পাশে রাখা হয় নাম-পরিচয়হীন রোগীদের। সেখানের একটি বিছানায় ঠাঁই হয়েছে আবদুর রহমানের।
আজ সোমবার হাসপাতালে গিয়ে আবদুর রহমানের সঙ্গে কথা হলো। হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে তাঁর শীর্ণ শরীর। একটি চাদর তাঁর গায়ে দেওয়া। বিছানায় নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য মাছি ও তেলাপোকা। পায়ের কাছে ছোট্ট একটি অচল ফ্যান।
আবদুর রহমান ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। কথা জড়িয়ে যায়। কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলেন। কানেও কম শোনেন। গত ২৭ জুলাই আবদুর রহমানকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর প্রায় দুই মাসে কেউ তাঁর খোঁজ নেননি। ‘অজানা’ রোগীর তালিকাতেই রয়ে গেছেন তিনি।
হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স ফারুক হোসাইনসহ কয়েকজন মিলেই আবদুর রহমানকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘লোকটি (আবদুর রহমান) হাসপাতালের নিচতলার সিঁড়ির নিচে পড়ে ছিলেন। কে বা কারা যেন তাঁকে এখানে রেখে যায়। মারুফা জালাল নামের এক নারী এসে আমাদের খবর দেন। রোগীর সঙ্গে কেউ ছিলেন না। তারপর আমরা তাঁকে ভর্তি করি।’
জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স ফারুক হোসাইন বললেন, ‘আমরা প্রথমে এই রোগীকে মেডিসিন বিভাগে নিয়ে যাই। সেখান থেকে জানানো হয়, তাঁর বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা ছাড়া কোনো সমস্যা নেই। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত আবদুর রহমানের কোনো আত্মীয়স্বজনকে পাওয়া যায়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেগুনবাগিচায় খবর নিয়েছি, কিন্তু লোকটির কোনো স্বজনকে খুঁজে পাইনি।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অসিত চন্দ্র সরকার নিজেও আবদুর রহমানের চিকিৎসার খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানালেন ফারুক হোসাইন। মুঠোফোনে অসিত চন্দ্র সরকার বললেন, ‘আমাদের এখানে অজ্ঞাত রোগী সব সময়ই থাকে। জ্ঞান ফিরলে বা সুস্থ হলে আমরা তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করি। সাধারণত আমরা দীর্ঘদিন তাঁদের রেখে দিই। তত দিনে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ পাওয়া যায়। আর একেবারেই স্বজনদের পাওয়া না গেলে আমরা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিভাগের মাধ্যমে তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিই।’
আবদুর রহমানকে হাসপাতালে প্রথম যিনি দেখেছিলেন, সেই মারুফা জালাল প্রায় প্রতিদিনই আসেন, খোঁজখবর নেন, টাকাপয়সাও খরচ করেন। তিনি বললেন, ‘মানুষের জন্য মানুষ করবে তাই তো স্বাভাবিক। পশুপাখির জন্যও তো মানুষ করে, আর তিনি তো একজন অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষ। আমারও বাবা আছে। আমি আমার সাধ্যমতো করছি।’ ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আমার অনুরোধ, তারা যেন আরও কিছুদিন লোকটিকে ভর্তি রাখে। আমিও চেষ্টা করছি যাতে তাঁকে রাখার একটি জায়গার ব্যবস্থা করা যায়।’ বললেন মারুফা জালাল।