অভয়ারণ্যে মিলছে না ইলিশ
পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া নদী আর জীবিকা—দুটিই সমার্থক জেলে আখের আলী খাঁর (৪৫) কাছে। ছেলে সোহেলকে (২০) নিয়ে তিনি এই নদীতে ইলিশ শিকার করেন। নৌকা ও জাল কেনা এবং মেরামতের জন্য ইলিশের মৌসুম শুরুর আগে ঋণ করেন। মৌসুম এলে চার-পাঁচ মাস ইলিশ শিকার করেন। সেই মাছ বিক্রির আয় দিয়ে ঋণ শোধ দেন। বাকি টাকায় সংসার চলে। কিন্তু এই মৌসুম যেন ভিন্ন কিছু হয়ে সামনে এসেছে আখের আলীর। তেঁতুলিয়া নদীর কোথায় কতটা, কেমন ইলিশ মেলে—সবই তাঁর নখদর্পণে। কিন্তু নির্দিষ্ট সেই জায়গাগুলোতে জাল টেনেও তেমন ইলিশ মিলছে না।
যারপরনাই হতাশ দশমিনা উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীপারের সৈয়দ জায়র গ্রামের বাসিন্দা আখের আলী খাঁ। বললেন, তাঁদের এলাকাটি ইলিশের অভয়ারণ্য। কিন্তু এখানেও এবার ইলিশ খুব কম ধরা পড়ছে। ভরা মৌসুমের তিন মাস পার হয়ে গেলেও আশানুরূপ ইলিশ না মেলায় বড় দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। কারণ, এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) থেকে ঋণ নিয়েছেন। তার কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর ওপরে রয়েছে মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া দাদনের টাকা। এখন কীভাবে এসব টাকা পরিশোধ করবেন, আর কীভাবে সংসার চালাবেন—সেই চিন্তায় সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে।
আখের আলী খাঁর মতোই হতাশ পটুয়াখালীর ২৫ হাজারের বেশি ইলিশ-নির্ভর জেলে। তাঁরা বলছেন, ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে এখন। নদীর নির্দিষ্ট এলাকায় জাল ফেললেই ইলিশের দেখা মেলার কথা। কিন্তু পটুয়াখালীর নদ-নদীতে তেমন একটা ইলিশ ধরা পড়ছে না। এমনকি ইলিশের অভয়ারণ্য ১০০ কিলোমিটার তেঁতুলিয়া নদীতে সেভাবে ইলিশের দেখা মিলছে না।
তবে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন, জেলেদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এর প্রভাবে মৌসুমের আগপিছ হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। ভারী বৃষ্টিপাত ও পানি বাড়তে শুরু করলে ইলিশের প্রাচুর্য বাড়বে। তখন জেলেরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
প্রতিবছর ইলিশ আহরণের মৌসুম শুরু হয় জুন থেকে, চলে অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে জেলেরা পটুয়াখালীর পায়রা, আগুনমুখা, আন্ধারমানিক, বুড়াগৌরাঙ্গ, তেঁতুলিয়া নদীতে জাল ফেলেন রুপালি ইলিশের আশায়। জেলার হাজার হাজার জেলের জীবনজীবিকা মৌসুমি এই ইলিশ ধরার ওপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু এ বছর মৌসুমের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও আশানুরূপ ইলিশ মিলছে না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর পটুয়াখালীর নদ-নদীতে জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ইলিশ আহরিত হয়েছিল ১০ হাজার ৩৫১ দশমিক ৮৭ মেট্রিক টন। কিন্তু এ বছর ওই তিন মাসে ইলিশ আহরিত হয়েছে ৭ হাজার ৫৩৪ দশমিক ৪৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এ বছর প্রথম তিন মাসে ২ হাজার ৮১৯ দশমিক ৩৯ মেট্রিক টন ইলিশ কম ধরা পড়েছে। জেলায় ইলিশনির্ভর জেলে রয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৬০ জন। তাঁদের মধ্যে নদ-নদীতে ইলিশ ধরেন ২৫ হাজার ১৭৩ জন।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর সাগরের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় বেশ ইলিশ ধরা পড়ছে। তবে পটুয়াখালীর নদ-নদীতে আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়ছে না। ফলে যেসব জেলে নদ-নদীনির্ভর, তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা ইলিশের অভয়ারণ্যেও ভরা মৌসুমে এই মাছ প্রত্যাশা অনুযায়ী ধরা না পড়ায় বিস্মিত জেলেরা।
গত বুধবার সকালে দশমিনা উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীপারের সৈয়দ জায়র গ্রামে গিয়ে জেলেদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। প্রত্যেক জেলের কণ্ঠেই আশানুরূপ ইলিশ না পাওয়ায় হতাশার সুর। এসব জেলের প্রায় প্রত্যেকেই দরিদ্র। ইলিশের মৌসুমের শুরুতে তাঁরা এনজিও থেকে ঋণ করেছেন। আড়তদারদের কাছ থেকে ইলিশ দেওয়ার কথা বলে দাদন নিয়েছেন।
জেলে ইসতাক ভূঁইয়ার (৪০) দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে রাকিব (১০) ও মেয়ে সুমাইয়া (১২) দুজনই স্কুলে পড়ে। মাছ ধরেই চার সদস্যের পরিবারের সব খরচ চালান তিনি। ইসতাক বলেন, ‘স্ত্রী রোজিনা বেগম এনজিও দিয়া লোন আনছে। বাজারের আড়তদারদের কাছ ইলিশ দেওয়ার কথা কইয়া দাদন নিছি। হেই টাহা দিয়া নৌকা-জাল করছি। এহন এনজিও কিস্তির টাকা, হের লগে মহাজনের দাদন। নদীতে গিয়ে যে পরিমাণ ইলিশ পাই, তাতে সংসারই চলে না। ধারদেনা শোধ করুম কেমনে?’
ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে প্রতিবছর নভেম্বর মাসে তেঁতুলিয়া নদীর ওই ১০০ কিলোমিটারে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকেও এই অভয়ারণ্যে ব্যাপক নজরদারি থাকে। ফলে নিষেধাজ্ঞার সময় চলে আসার আগেই জেলেরা পর্যাপ্ত ইলিশ ধরতে না পারলে বিপাকে পড়বেন।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাগরে পর্যাপ্ত ইলিশ রয়েছে। বর্তমানে ইলিশের মৌসুম শুরু হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টি কম হওয়ায় ইলিশ পেতে দেরি হচ্ছে। তবে এ মৌসুমেই নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাবে। জেলেরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে আমরা আশা করছি।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ অনুষদের ডিন মো. লোকমান আলী বলেন, ‘মৌসুমের তিন মাস চলে গেলেও ইলিশ তেমন না পাওয়ায় হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রাকৃতিক নিয়মের ওপরই নির্ভর করতে হবে। মনে হচ্ছে, সামুদ্রিক প্রতিবেশে বড় ধরনের পরিবর্তনের কারণে ইলিশের প্রজনন ও ধরার মৌসুমে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের ঋতুগুলোতেও আলাদা বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর প্রভাবে মৌসুমের আগপিছ হচ্ছে। তবে ভারী বৃষ্টিপাত ও পানি বাড়তে শুরু করলে ইলিশের প্রাচুর্য বাড়বে।’