জাকসু নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি
আগামী নভেম্বরের মধ্যেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সে অনুযায়ী গত ৩১ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরপর এক মাস পার হলেও নির্বাচন কমিশন পূর্ণাঙ্গ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের অনেকেই জাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ, উপাচার্যের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো বলছে, চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে যেসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো ধামাচাপা দিতেই জাকসু নির্বাচনের প্রসঙ্গ সামনে এনেছিল প্রশাসন।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে জাকসু নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়। অবিলম্বে নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। গত ২৭ জুন নির্বাচন প্রস্তুতিমূলক কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২৮ জুন সিনেট অধিবেশন শুরুর আধা ঘণ্টা আগে সিনেট কক্ষ ঘেরাও করে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। আন্দোলনের মুখে আগামী নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দেন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, জাকসু নির্বাচন করতে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় আছে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে যেসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, সেসব অনিয়ম ধামাচাপা দিতেই জাকসু প্রসঙ্গ সামনে এনেছিল প্রশাসন।
কবে হবে পূর্ণাঙ্গ কমিশন
বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মহলেই প্রশ্ন, জাকসু নির্বাচন কি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগেই আটকে থাকছে। তবে শিগগিরই নির্বাচন কমিশন পূর্ণাঙ্গ করার আশা প্রকাশ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আব্দুল মান্নান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপাচার্যের সঙ্গে কয়েক দিন আগে আমার কথা হয়েছে। তিনি শিগগিরই কমিশন পূর্ণাঙ্গ করার কথা বলেছেন।’ এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, ‘জাকসু নির্বাচনের বিষয়ে প্রশাসনের ধীরগতি লক্ষ করছি। তবে আমরা চাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন পূর্ণাঙ্গ হোক।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান চায়। সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সোহেল রানা বলেন, ‘প্রায় এক মাস আগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে জাকসু নিয়ে আলোচনায় সহাবস্থানের দাবি জানালেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখছি না।’
শেষ হয়নি গঠনতন্ত্র সংশোধন
নির্বাচন প্রস্তুতিমূলক কমিটিকে জাকসুর পুরোনো গঠনতন্ত্র সংশোধনের দায়িত্ব দেয় প্রশাসন। এ উদ্দেশ্যে গত ২৫ জুলাই কমিটির প্রথম সভায় কমিটির সদস্যরা পুরোনো গঠনতন্ত্র সংশোধন করার জন্য দুই দিন সময় নেন। এরপর ২৭ জুলাই সংশোধিত খসড়া গঠনতন্ত্র প্রস্তাব এবং ২৯ জুলাই থেকে প্রস্তাবিত এই গঠনতন্ত্র আরও সংশোধনের জন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে শুরু করে কমিটি।
নির্বাচন প্রস্তুতি কমিটি সূত্র জানায়, গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তালিকাভুক্ত সব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা গত ২০ আগস্ট শেষ হয়েছে। সব সংগঠনই জাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে। তাঁদের প্রস্তাবগুলো নিয়ে নির্বাচন প্রস্তুতি কমিটি আলোচনা করবে।
নির্বাচন প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আব্দুস সালাম মিঞাঁ বলেন, ‘গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনার কাজ চলছে। শিগগিরই কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।’
২৬ বছর অচল জাকসু
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পরের বছরই প্রথম জাকসু নির্বাচন হয়। এরপর ১৯৭৪, ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালসহ মোট আটবার নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯২ সালে শেষবারের মতো নির্বাচন হয়। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাবে ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালালে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ভেঙে দেয় প্রশাসন।
এ ঘটনার দুই দশক পর ২০১২ সালের ১৭ মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। ২০১৩ সালের নভেম্বরে তিনি জাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। এরপর ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি জাকসু নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করা হয়।
তবে এমফিল এবং পিএইচডির শিক্ষার্থীরাও নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দেওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই। তৎকালীন শিক্ষক সমিতির নেতারাও এর বিরোধিতা করেন। এরপর ওই বছরের ২৬ নভেম্বর নির্বাচন কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। কমিশন তখন জানিয়েছিল, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। এরপর ঘুরেফিরে আলোচনায় থাকলেও আলোর মুখ দেখেনি জাকসু নির্বাচন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন উপাচার্য। কিন্তু কাজের অগ্রগতি দেখে মনে হচ্ছে, নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া অসম্ভব।
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সময়মতো নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) নূরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাকসুর কার্যক্রম নিজ গতিতেই চলবে। আমরা আশা করছি, উপাচার্যের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী নভেম্বরেই এই নির্বাচন হবে।’