'আমার তো লাইফ শেষ, কী যে কষ্ট'
‘আমার তো লাইফ শেষ। ওহ্, কী যে কষ্ট! এই কষ্ট অন্য কেউ বুঝতে পারবে না।’ কথাগুলো বলছিলেন কৃষ্ণা রায় চৌধুরী (৫২)। গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় ট্রাস্ট পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের চাপায় এক পা হারান তিনি।
কৃষ্ণা রায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সহকারী ব্যবস্থাপক।
গতকাল সোমবার দুপুরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) কথা হয় কৃষ্ণা রায়ের সঙ্গে। পা প্রথমে হাঁটুর নিচ থেকে কাটা হলেও গত রোববার দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচারে তা হাঁটুর ওপর থেকে কাটতে হয়েছে। বাঁ পায়ের ক্ষতস্থান থেকে কিছু অংশ পচে যাচ্ছিল। গতকাল দেখা গেল, কৃষ্ণা রায়ের এক পা চাদরের বাইরে। আর সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো অর্ধেক পা চাদরে ঢাকা।
ওই দিন ঘটনার সময় ট্রাস্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের বাসটি চালাচ্ছিলেন মোরশেদ (৩৫)। ট্রাস্টের বাস চালানোর প্রথম দিনেই মোরশেদ চাপা দেন কৃষ্ণা রায়কে।
মোরশেদকে রোববার রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকার কাজীপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একটি দল।
গতকাল হাসপাতালে যখন কথা হচ্ছিল, ততক্ষণে কৃষ্ণা রায় বাসচালক গ্রেপ্তারের খবরটি জেনে গেছেন। তিনি বললেন, ‘বাসের চালক ধরা পড়লেই কী? সে হয়তো কয়েক মাস জেল খাটবে। এতে করে আমি তো আমার পা ফিরে পাব না।’
ঘটনার পর বিভিন্ন ধকলের পর কৃষ্ণা রায় অনেকটাই স্বস্তি পাচ্ছিলেন বলে জানালেন। মাথায় বিভিন্ন জায়গায় আঘাত বা কাটা পায়ের আঘাতের ব্যথা খানিকটা থেমেই ছিল। তবে কথায় কৃষ্ণা রায়ের রাগ-ক্ষোভের আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি বাসের চাপায় পা হারানোর ঘটনাকে কোনোভাবেই দুর্ভাগ্য বলতে রাজি নন, ‘আমি তো রাস্তা পার হতে যাইনি। আমি ফুটপাতে ছিলাম। আমার তো কোনো দোষ ছিল না। ফুটপাত তো পথচারীর চলাচলের জন্যই।’
কথা বলার সময়ই নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল গণি মোল্লাহ কৃষ্ণা রায়কে দেখতে আসেন। পরে তিনি জানালেন, কৃষ্ণা রায়ের শারীরিক অবস্থা অন্য দিনের তুলনায় অনেকটাই ভালো। শরীরে ব্যথা কম, জ্বর আসেনি। প্রস্রাবের পরিমাণ ঠিক আছে। নিয়মমতো ড্রেসিং করলে খুব দ্রুতই হয়তো তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে। কাটা জায়গা ভালো হলে তিন মাস পর কৃত্রিম পা লাগানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
সেই দিনের ঘটনা উল্লেখ করে কৃষ্ণা রায় জানান, বাংলামোটরে যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে, তার উল্টো পাশেই তাঁর অফিস। দুপুরে তিনি ব্যাংকে যাওয়ার জন্য ফুটপাতে দাঁড়ান। হঠাৎ দেখতে পান, একটি বাস ফুটপাতের দিকে ধেয়ে আসছে এবং সরাসরি তাঁর দিকেই আসছে বাসটি। বাসটি যখন অনেকটা কাছাকাছি চলে আসে, তখন তিনি সেখান থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু লোহাসহ বিভিন্ন জিনিসের কারণে ফুটপাতটি সরু ছিল। বাঁ পা আর সরাতে পারেননি। দুম করে বাসটি এসে পায়ে আঘাত করে। সেখানে ছোট একটি গর্তে পড়ে যান তিনি।
দুর্ঘটনার কথা মনে করে কৃষ্ণা রায় বললেন, ‘সেখানে কতক্ষণ সময় গেছে জানি না। পরনের শাড়ির কুঁচি ছিঁড়ে যায়। পেটিকোটের ফিতা পর্যন্ত খুলে যায়। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল। ডান পা তুলতে পারি কিন্তু বাঁ পা তুলতে পারি না। পা ওঠে না কেন? কী ব্যাপার? তখনো জানি না পা কেটে গেছে। হাত দিয়ে পা টাইন্যা তোলার চেষ্টা করি। রক্ত আর রক্ত। দেখলাম থেঁতলে গেছে। বুঝলাম পা কেটে গেছে।’
দুর্ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একে ছেলে এগিয়ে আসেন উল্লেখ করে কৃষ্ণা রায় বলেন, ‘ওই ছেলে পথচারীদের কতজনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাল, কিন্তু কেউ আসে না। পরে ওই ছেলের বয়সী আরেকজনকে ডেকে বলে, “আন্টিকে হাসপাতালে না নিলে বাঁচানো যাবে না।” পরে এই দুজন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে অফিস এবং পরিবারের লোকজনদের খবর দেওয়া হয়।’
কৃষ্ণা রায় আক্ষেপ করে বলেন, রূপকথার গল্পে একেকজনের জীবন থাকে টিয়াপাখির মধ্যে। আর বর্তমানে মানুষের জীবন থাকে গাড়ির মধ্যে।
ঘটনার পরদিন ২৮ আগস্ট সন্ধ্যায় কৃষ্ণা রায়ের স্বামী রাধে শ্যাম চৌধুরী একটি মামলা করেন। কৃষ্ণা রায়ের একমাত্র ছেলে কৌশিক চৌধুরী জানালেন, ঘটনার পর বাসমালিকের পক্ষের লোক পরিচয়ে দুজন এসে মায়ের পায়ের জন্য দুই লাখ টাকা দিতে চান। ক্ষোভ প্রকাশ করে কৌশিক চৌধুরী বললেন, ‘আমার মায়ের কাটা পা তাঁদের কাছে পণ্য মনে হয়েছে। এমন একটা ভাব, দুই লাখ টাকা দিলেই পা ভালো হয়ে যাবে।’
কৌশিক চৌধুরী কথা বলার সময়ে কৃষ্ণা রায়ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দুই লাখ টাকা দিতে চাইলে আমার অফিসের চেয়ারম্যান খুব রেগে যান। তিনি ওই লোককে বলেন, আপনাকে দুই লাখ টাকা দিচ্ছি, আপনি আপনার পা রেখে যান। তাহলেই বুঝবেন পা হারানোর কী কষ্ট?’ কৃষ্ণা রায় নিজে নিজেই বললেন, ‘কাটা পায়ের দাম দুই লাখ টাকা হয় কেমনে?’
জানা গেল, কৃষ্ণা রায়ের স্বামী শিক্ষকতা করতেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, অসুস্থ। দু–একটা টিউশনি করেন। কৌশিক চৌধুরী এখন পর্যন্ত চাকরিতে ঢোকেননি। এই দম্পতির একমাত্র মেয়ে ঐশ্বরিয়া চৌধুরী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছেন। বলতে গেলে কৃষ্ণা রায়ের চাকরির টাকা দিয়েই পুরো সংসার চলত। এখন পরিবারটি চোখে অন্ধকার দেখছে। কৃষ্ণা রায়ের কৃত্রিম পা লাগানো হলেও তিনি আর আগের মতো কাজ করতে পারবেন না।
কৃষ্ণা রায় বললেন, ‘আমি শুধু চালক না, বাসের মালিকেরও কঠোর শাস্তি চাই। সুষ্ঠু বিচার চাই। চালক ও মালিকের যাবজ্জীবন শাস্তি চাই। আর মালিকদের ট্রিপ ট্রিপ খেলা যাতে বন্ধ হয়। মালিকেরা কেন সময় নির্দিষ্ট করে দেন চালকদের? রাস্তায় চালকদের যতক্ষণ লাগবে ততক্ষণই সময় দিতে হবে। তাড়া দেওয়া যাবে না।’
আরও পড়ুন: