কাগজের ফুল নিয়ে সাহারার সংগ্রাম
সড়কের পাশে বিছানো একটি পলিথিনের ওপর সাজানো নানা রং ও নকশার কাগজের ফুল। স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা আসছেন, নেড়েচেড়ে দেখছেন। দু–একজন কিনছেনও। বিভিন্ন স্কুলের সামনে নিজের হাতে তৈরি কাগজের ফুল বিক্রি করেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সাহারা বেগম। প্রতিদিন রোদ-বৃষ্টির মধ্যে কাগজের ফুলের ঝোলা নিয়ে ঘর থেকে বের হন তিনি। আজ খিলগাঁও গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পসরা সাজিয়ে বসেছেন। তাঁর তৈরি একেকটি ফুলের দাম ৫ থেকে শুরু করে ১০০ টাকা। ১০০ টাকা দামের ফুল একটি—ফিরোজা রঙের পাতায় ছাওয়া বড় বড় তিনটি ফুল ও একটি কুঁড়ি। ফুলটি কয়েক দিন আগে বানিয়েছেন। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না। দাম নাকি বেশি।
আজ বুধবার দুপুরে সাহারার সঙ্গে কথা হলো। নিজের হাতে ফুল বানিয়ে সাহারা আগেও টুকটাক বিক্রি করেছেন, কিন্তু কখনো এটিকে আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে দেখেননি। আর সড়কের পাশে বসে ফুল বিক্রি করার কথা তো কখনো কল্পনাও করেননি। চার–পাঁচ বছর আগে স্বামী আরেকটি বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর তাঁকে বাধ্য হয়েই এভাবে কাগজের ফুল বিক্রির পথ বেছে নিতে হয়েছে। বললেন, ‘নিজের কাজ নিজে করি, লজ্জার কিছু নেই। বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করে ভালো, শরীর ও মনও ভালো থাকে।’ আরও বললেন, কাগজ দিয়ে ফুল বানাতে তাঁর খুবই ভালো লাগে।
সাহারার জন্ম ঝালকাঠি জেলায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। সাহারা যখন খুব ছোট তখন তাঁরা ঢাকায় পাড়ি জমান। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার ঝালকাঠিতে ফিরে যেতে হয়। সেখানেই এসএসসি পাস করেছেন তিনি। আর পড়ালেখা করা হয়নি। পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতেই কাগজের ফুল তৈরির নেশায় ধরে সাহারাকে। তখন ছিল শুধুই শখ—এখন জীবিকার অবলম্বন।
সাহারা এখন তাঁর ১৬ বছরের ছেলেকে নিয়ে মা–বাবার সঙ্গে রাজধানীর মালিবাগে থাকেন। সংসার চালাতে সাহারার ভাইবোনেরা কিছু সাহায্য করেন। কিন্তু নিজের এবং ছেলের খরচ সাহারাকেই জোগাতে হয়। মা–বাবাকেও সাহায্য করেন। সাহারা জানালেন, তাঁর ভাইবোনেরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। সবাই সচ্ছল। সাহারার ফুল ফেরি করা নিয়ে তাঁর ভাইবোনেরা বিব্রত হয় কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাহারা বলেন, ‘তাঁরা বিব্রত হয়। কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই। আমি যখন বেকার ছিলাম, তখন তো কেউ আমাকে সাহায্য করেনি।’
১০ ধরনের ফুল তৈরি করতে জানেন সাহারা। বললেন, ‘শেখার সুযোগ থাকলে আরও অনেক কিছু বানাতে পারতাম।’ জানালেন, আগে বিক্রি ভালো হতো। এখন অনেকেই খুব সহজে এসব ফুল বানানো শিখে নিতে পারছে বলে বিক্রি কমে গেছে। ফুল তৈরি করতে তাঁর মাসে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পুঁজির প্রয়োজন হয়। অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে সাহারা সাভারে এক কাঠা জমি কিনেছেন।
একমাত্র সন্তান সাফিন জামান নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছেলেকে ঘিরেই সাহারার জীবন আবর্তিত। ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করাই সাহারার জীবনের ব্রত। গ্রামে একটি বাড়ি করার স্বপ্ন দেখেন এবং ছেলেকে নিয়ে সেখানেই ফিরে যেতে চান তিনি।