মাদারীপুরে সবকিছুতেই 'শাজাহান লীগ' বনাম 'নাছিম লীগ'
মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলে দুই নেতার কথায়। তাঁদের একজন সদর উপজেলার সাংসদ শাজাহান খান। অন্যজন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তাঁদের দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব এলাকায় গোপন কোনো বিষয় নয়। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ভাষায়, জেলায় ‘শাজাহান লীগ’ ও ‘নাছিম লীগ’-এর বাইরে কিছু নেই।
গত জুন মাসে অনুষ্ঠিত মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে। তিনি বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারী। নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন শাজাহান খানের ছোট ভাই ওবায়দুর রহমান খান। ভোটে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন বিদ্রোহী প্রার্থী। নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের পর দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। খুন হন পরাজিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা ওয়ার্ড যুবলীগের এক নেতা। পরাজিত প্রার্থীর অনুসারীদের ৪০টি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। আহত হন অন্তত ৩০ জন। হত্যার ঘটনায় ওবায়দুর রহমানের সমর্থকদের নামে মামলা হয়।
জেলার শিবচর ও কালকিনি উপজেলায় দলীয় বিরোধ না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবার নৌকার প্রার্থী জয়ী হন। কিন্তু রাজৈর উপজেলায় শাজাহান খানের অনুসারী নৌকার মনোনয়ন পেলে নাছিমের অনুসারীরা বিদ্রোহী প্রার্থী দেন বলে অভিযোগ আছে। সেখানেও বিজয়ী হন শাজাহান খানের প্রার্থী।
স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে জাসদ ছেড়ে শাজাহান খানের আওয়ামী লীগে যোগদান করার পর দলে বিভক্তি বাড়ে। নাছিমের অনুসারীরা বসেন শহরের পুরান বাজারে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। সেখান থেকে আধা কিলোমিটার দূরে চানমারি এলাকায় শাজাহান খানের কার্যালয়ে বসেন তাঁর অনুসারীরা। দলীয় কর্মসূচিও পৃথকভাবে পালন করেন তাঁরা।
জেলা আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ২৮ বছর ধরে শাজাহান ও নাছিমের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা-মামলার ঘটনাও কম নয়। এমন রাজনীতি কখনোই চলতে পারে না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ।
>স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ভাষায়, জেলায় ‘শাজাহান লীগ’ ও ‘নাছিম লীগ’-এর বাইরে কিছু নেই।
মাদারীপুরে তিনটি সংসদীয় এলাকা। মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসনটি স্বাধীনতার পর থেকেই বর্তমান সাংসদ নূরে আলম চৌধুরীর পরিবারের হাতে। মাদারীপুর-২ (সদর ও রাজৈর) আসন থেকে এ পর্যন্ত সাতবার সাংসদ হয়েছেন শাজাহান খান। তাঁর বাবাও এই আসনে তিনবার সাংসদ ছিলেন। মাদারীপুর-৩ (সদরের একাংশ ও কালকিনি) আসনটিতে গত তিন নির্বাচনে প্রার্থী পাল্টেছে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সৈয়দ আবুল হোসেন, ২০১৪ সালে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সর্বশেষ ২০১৮ সালে দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে সাংসদ হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান। দলীয় সূত্র জানায়, নূরে আলম চৌধুরী মাদারীপুর শহরের রাজনীতিতে সেভাবে যুক্ত না হলেও আত্মীয়তার সুবাদে নাছিমের সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে। আবুল হোসেন ও গোলাপের তেমন কোনো প্রভাব নেই শহরের রাজনীতিতে।
স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, মাদারীপুর শহরের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মূলত শাজাহান ও নাছিমের মধ্যে দ্বন্দ্ব। মাদারীপুর সদর পৌরসভার বর্তমান মেয়র নাছিমের ছোট ভাই খালিদ হোসেন। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আগে ছিলেন শাজাহান খানের চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান খান। তাঁর সঙ্গে খান পরিবারের বিরোধ চলছে দুই বছর ধরে।
পাভেলুর রহমান বলেন, ২৮ বছর ধরে রাজনীতি করেও সাংসদ মন থেকে আওয়ামী লীগের হতে পারেননি। এখনো জাসদের আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেন তিনি।
তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট বলে মন্তব্য করেন শাজাহান খান। তিনি দাবি করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর জাসদে যোগ দেওয়ার কারণ দলের নেত্রী জানেন। নেত্রী আমাকে আওয়ামী লীগে ফিরিয়ে এনেছেন।’
শাজাহান খানের অনুসারী নেতা-কর্মীরা বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা প্রয়াত আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে জাসদে যান শাজাহান খান। রাজ্জাকের অনুসারীরা সেই বিরোধ টিকিয়ে রেখেছেন। বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ মোল্লাও রাজ্জাকের অনুসারী ছিলেন। রাজ্জাকের অনুসারীরা এখন নাছিমের সঙ্গে রয়েছেন। ২০১৪ সালে তাঁকে (নাছিম) কালকিনি থেকে সাংসদ করা হলেও বিরোধ দূর হয়নি। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন দাবি করেন, দলের অধিকাংশ কর্মী শাজাহান খানের পক্ষেই আছেন।
দলের নেতারা জানান, ১৯৯১ সালে মাদারীপুর সদর আসনে নৌকা নিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন আবদুর রাজ্জাক। তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হন শাজাহান খান। তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস জমাদ্দার এর বিরোধিতা করে বিদ্রোহী প্রার্থী হন। তবে নির্বাচনে হেরে যান তিনি। ওই নির্বাচনের সময় শাজাহান খানের পক্ষে ছিলেন নাছিম। পরে রাজ্জাকের অনুসারীরা (পুরোনো আওয়ামী লীগ হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত) নাছিমের নেতৃত্বে আলাদা বলয় তৈরি করেন।
দলে বিরোধের বিষয়ে বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব সময় আওয়ামী লীগের আদর্শিক রাজনীতিটাই করি। দলকে ভালোবেসে আওয়ামী লীগের সবার সঙ্গে আছি। বাকিরাও যদি আওয়ামী লীগ ভালোবাসে, কোনো দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়।’
জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে দলে বিভেদ বাড়ছে। দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া এ দ্বন্দ্ব দূর করা সম্ভব নয়।