'গেম'-এর নামে মৃত্যুর মুখে
লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালিযাত্রাকে দালালেরা বলে ‘গেম’। এই গেম কখনো ছোট নৌকা, কখনো জাহাজে করে হয়। এসব নৌযানে গাদাগাদি করে গেমে অংশ নেন অভিবাসনপ্রত্যাশী লোকজন। ভাগ্য ভালো হলে এই তরি তীরে ভেড়ে, না হলে সলিলসমাধিও হয় অনেকের।
এমনই একটি গেম থেকে সম্প্রতি বেঁচে এসে এ কাহিনি শুনিয়েছেন শিপন মিয়া (২০)। ভূমধ্যসাগর থেকে তাঁদের উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার একটি জাহাজ। তিউনিসিয়া থেকে গত ২১ জুন ১৬ বাংলাদেশির সঙ্গে ঢাকায় ফেরেন তিনি। ২৩ জুন রাতে বাড়ি পৌঁছান তিনি।
শিপনের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মুনিরগাতি গ্রামে। বাবা হেলাল আহমদ, মা মিনারা বেগম। চার ভাইয়ের মধ্যে শিপন সবার ছোট। বিদেশে যাওয়ার আগে তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। অন্য ভাইয়েরা কৃষিকাজ করেন।
শিপন শুনিয়েছেন সেই ভয়ংকর গেমের কথা। প্রথমে তিনি জানান গেমের শুরুর কথা। বলেন, তাঁদের পাশের মায়েরকোল গ্রামের লুৎফর রহমান লিবিয়ায় থাকেন। লুৎফরের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য আট লাখ টাকায় চুক্তি হয় তাঁর। কথা ছিল, ইতালি পৌঁছার পর টাকা দিলে চলবে। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাড়ি ছাড়েন শিপন। এরপর ঢাকা থেকে বিমানে দুবাই, এরপর মিসর হয়ে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে পৌঁছান তিনি। লিবিয়ায় কিছুদিন লুৎফরের সঙ্গে ছিলেন তিনি। সেখানে তাঁকে রঙের কাজ দেওয়া হয়। প্রায় দুই মাস এই কাজ করেন তিনি।
এত দিন কাজ করলেও বেতন দেওয়া হয়নি শিপনকে। থাকা-খাওয়াই সই। এরপর শুরু হয় গেম শুরুর আগের নির্যাতনের কাহিনি।
শিপন বলতে থাকেন, একদিন জানানো হয়, তাঁর গেমের সময় হয়ে গেছে। অন্য লোকদের হাতে তাঁকে তুলে দেওয়া হয়। ওই ব্যক্তিরা তাঁকে ছোট্ট ঘরে নিয়ে বন্দী করে। সেখানে আরও লোকজন ছিলেন। শুরু হয় টাকার জন্য নির্যাতন। খাবার-দাবার প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। দিনে একবার পাতলা খিচুড়ি আর এক গ্লাস পানি দেওয়া হতো। দুই-তিন দিন পর সামান্য ভাত। সহ্য করতে না পেরে পরিবারের কাছে টাকার জন্য ফোন করে কান্নাকাটি করেন শিপন। বাবা ও ভাইয়েরা জমি বিক্রি ও ঋণ করে সাড়ে চার লাখ টাকা দেন লুৎফরের বাবা জমির আলীর হাতে। কিন্তু গেম আর হয় না। আরও টাকা চাওয়া হয়। এভাবে কয়েক দফায় আট লাখ টাকা নেওয়া হয়। এই সময় এক জায়গায় কিছুদিন রেখে স্থান পরিবর্তন করা হতো। তাঁরা একসঙ্গে ৬৪ জন বন্দী ছিলেন। সবাই কান্নাকাটি করতেন।
একদিন এই কান্নাকাটির সাময়িক সমাপ্তি হয় শিপনদের। কিন্তু কে জানত এরপর তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও ভয়ংকর দুঃসময়!
>শিপন মিয়া বিদেশে যাওয়ার আগে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন
কাজ করলেও বেতন দেওয়া হয়নি শিপনকে
শিপনের জন্য টাকা জোগাড় করতে জমিজমা ও ছয়টি গরু বিক্রি করতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে
শিপন বলে যান, গত ৯ মে তাঁদের গেম শুরু হয়। ছোট একটি নৌকায় ৬৪ জনকেই তোলা হয়। সেটি ছাড়ার এক দিন পরই তেল শেষ হয়ে যায়। উত্তাল সাগরে ভাসতে থাকেন তাঁরা। কূল-কিনারা নেই। খাবার নেই, ঘুম নেই। অবস্থা কাহিল। হঠাৎ একটি জাহাজ দেখে সবাই চিৎকার করতে থাকেন। কাছাকাছি আসার পর তাঁরা জানতে পারেন, এটি তিউনিসিয়ার। তাঁদের উদ্ধার করা হয়।
শিপন এখনো ঠিক ধাতস্থ হতে পারেননি। বলেন, ‘কঠিন সে সময়ে বারবার মা-বাবার কথা মনে হচ্ছিল। দেশের কথা মনে হচ্ছিল। কান্নার শক্তিও ছিল না। বাঁচার আশা ছেড়েই দিছিলাম। কী করে যেন বেঁচে ফিরলাম! এখনো সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয়!’
শিপনের বাবা হেলাল আহমদ বলেন, শিপনের জন্য টাকা জোগাড় করতে জমিজমা ও ছয়টি গরু বিক্রি করতে হয়েছে তাঁদের। সুদে টাকা আনতে হয়েছে। আত্মীয়স্বজনদের কাছে হাত পাততে হয়েছে। এখন এই টাকা কীভাবে শোধ করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন।
এলাকার কয়েকজন জানান, লুৎফর কয়েক বছর ধরে লিবিয়ায় থাকেন। এবার তিনি লিবিয়া হয়ে ইতালিতে লোক পাঠানোর জন্য এলাকায় নানাভাবে যোগাযোগ করেন। কিন্তু শিপন মিয়ার ঘটনার পর থেকে তাঁর যোগাযোগ বন্ধ। তিনি দক্ষিণ খুরমা ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মছব্বিরের ভাগনে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করেও লুৎফর রহমান বা জমির আলী কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জমিরের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে আবদুল মছব্বির গত বৃহস্পতিবার বলেন, লুৎফরের বাবা জমির আলী টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে এর পরিমাণ নিয়ে দুপক্ষ দুই ধরনের কথা বলছে। বিষয়টি সামাজিকভাবে সালিসের মাধ্যমে মীমাংসা করবেন তাঁরা।
এ ব্যাপারে ছাতক থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে কেউ তাঁদের জানাননি। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।