সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে কোথাও পদের চেয়ে শিক্ষক বেশি, কোথাও নেই
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকের পদ রয়েছে আটটি। পদের বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ১১ জন। ধানমন্ডির গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে গণিতে ছয়টি পদের বিপরীতে শিক্ষক আছেন আটজন। অথচ ধানমন্ডি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে পুরান ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকের আটটি পদের বিপরীতে আছেন পাঁচজন। রাজধানীর এই তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই শিফট (দুই পালা) চালু রয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির নিজ জেলা চাঁদপুরের হাইমচর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে কোনো শিক্ষকই নেই। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, অতিথি শিক্ষক দিয়ে গণিত ক্লাস চালানো হচ্ছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তথ্য এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শহরের অভিজাত এলাকায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞানসহ কয়েকটি বিষয়ে পদের অতিরিক্ত শিক্ষক রয়েছেন। অন্যদিকে শহরের যে এলাকায় সুযোগ–সুবিধা তুলনামূলক কম এবং জেলা–উপজেলার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে পরীক্ষার ফল ও ভর্তিতে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, কখনো কখনো হয়তো সুষম বণ্টনে সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১ হাজার ৩৭৮টি পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকারি কর্ম কমিশনকে (পিএসসি) বলা হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হয়ে গেলে সংকট আর থাকবে না।
মাউশির তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এখন ৬৬২টি। এর মধ্যে পুরোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩৪৮টি। বাকি ৩১৪টি বিদ্যালয় ২০১০ সালের পর জাতীয়করণ হয়। (এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির সুযোগ নেই)। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের অনুমোদিত পদ আছে ১০ হাজার ৫৬৩টি। কর্মরত আছেন ৮ হাজার ৫৬৪ জন। ১ হাজার ৯৯৯টি পদ শূন্য। এর মধ্যে গণিতে ১২৭টি, ইংরেজিতে ৩২৪টি ও ভৌতবিজ্ঞানে ২৯১টি পদ শূন্য। রাজধানীর বাইরের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের সংকট বেশি। যেমন বান্দরবানের আলীকদম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকই নেই।
মাউশির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, একশ্রেণির শিক্ষক আছেন, যাঁরা তদবির বা ‘অন্য উপায়ে’ ঘুরেফিরে সুবিধাজনক বিদ্যালয়ে পদায়ন পান।
২০১৭ সালের নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর ২৪টি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ৫২২ জন শিক্ষক ১০ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ বছর পর্যন্ত একই বিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। তাঁদের অনেকে কোচিং বা প্রাইভেট–বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বছরের পর বছর ঢাকার একই বিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন। সরকারকে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে ১০ বছরের বেশি সময় একই বিদ্যালয়ে থাকা শিক্ষকদের বিভাগের বাইরে বদলির সুপারিশ করেছিল দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েকজনকে বদলি করলেও পরে তা আটকে যায়। পরিস্থিতি এখনো কমবেশি আগের মতোই রয়ে গেছে বলে মাউশির কর্মকর্তারা জানান।
ইংরেজি ও গণিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং সবার জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষকের ঘাটতি থাকলেও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ঢাকার কয়েকটি বিদ্যালয়ে পদের অতিরিক্ত শিক্ষক রয়েছেন। ইংরেজি, গণিত ও ভৌতবিজ্ঞানের (একজনও নেই) শিক্ষকের ঘাটতি থাকা ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়েই সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে পদের চেয়ে দ্বিগুণ শিক্ষক আছেন (চারটি পদের বিপরীতে আটজন)। ঢাকার তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের ৪টি পদের বিপরীতে আছেন ১১ জন।
ইংরেজি, গণিত ও ভৌতবিজ্ঞানে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় সমস্যা হচ্ছে বলে জানান নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময়ই অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে এসব বিষয়ের ক্লাস চালাতে হয়। এমনকি দুই শাখাকে (সেকশন) একসঙ্গে করেও ক্লাস নিতে হচ্ছে।