বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা দরকার
অভিভাবকদের আর্থিক অবস্থার পাশাপাশি নিয়োগকর্তাদের মানসিকতাও শিশুশ্রমের জন্য দায়ী। শিশুশ্রম বন্ধ করতে শ্রম থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নতুনভাবে যাতে যুক্ত হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৮.৭: শিশুশ্রম নিরসনে অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা এসব কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. রুহুল আমিন বলেন, অভিভাবকদের আর্থিক অবস্থার পাশাপাশি নিয়োগকর্তাদের মানসিকতাও শিশুশ্রমের জন্য দায়ী। এ জন্য সব অংশীজনের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। এতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেনড বা জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগানোর সুযোগ বাড়বে।
সব শিশুকে অন্তর্ভুক্ত না করে কর্মপরিকল্পনা নিলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস শহীদ মাহমুদ। তিনি বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলির কারণেও শিশুশ্রম নিরসনের কাজের ধারাবাহিকতাকে বিঘ্নিত হচ্ছে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোশাক খাতকে শিশুশ্রমমুক্ত করার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নিলে সফলতা আসতে পারে। শিশুদের কাজ থেকে সরিয়ে শিক্ষার সুযোগের পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাও দরকার। পরে দক্ষতা অনুযায়ী তাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করতে হবে।
দরিদ্র পরিবারগুলোতে শিশুরা আর্থিক সহযোগিতা করে বলে জানান মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মজীবী শিশু সুরক্ষা বিভাগের সমন্বয়কারী রাফেজা শাহীন। তিনি বলেন, বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করে শিশুদের কাজ থেকে সরাতে হবে। সঠিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকারবিষয়ক সুশাসনের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, শিশুশ্রম নিরসনের যে হার, তাতে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। সার্বিক দারিদ্র্যের বাইরে গিয়ে শিশুদের দারিদ্র্য আলাদাভাবে দেখতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনে খাতভিত্তিক নয়, অঞ্চলভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে।
আইএলওর ন্যাশনাল প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর সুরাইয়া বানু বলেন, বয়স বাড়িয়ে অনেক শিশুই প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে, যাদের শনাক্ত করা হচ্ছে না। আবার বাংলাদেশ শ্রমে প্রবেশের ন্যূনতম বয়সসংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুস্বাক্ষর করেনি, যা শিশুশ্রম নিরসনে অত্যন্ত জরুরি।
গৃহকর্ম ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের যুগ্ম মহাসচিব এ মো. জাফরুল হাসান বলেন, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮—এই চার বছরের ১৮২ গৃহকর্মী হত্যা ও ১৪৬ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অথচ শ্রম আইনের আওতায় গৃহশ্রমিক আসে না।
ওয়ার্ল্ডভিশনের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড জাস্টিস ফর চিলড্রেনের উপপরিচালক সাবিরা নুপুর বলেন, সব শিশুকে একত্র করে সামগ্রিক পরিকল্পনা করতে হবে। শ্রমে জড়িত শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার পরে পরিবারগুলোকে নিয়মিত ও এককালীন আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
ইউনিসেফের চাইল্ড প্রটেকশন কর্মকর্তা শাবনাজ জাহেরীন বলেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করলেও সরকার এটা আমলে নেয় না। অথচ শিশুশ্রমের সঙ্গে যৌন নির্যাতন, পাচার ও অন্যান্য নির্যাতনের বিষয় জড়িত।
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত শিশুদের মধ্যে অনেকেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে উল্লেখ করে ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী বলেন, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আইনের মাধ্যমে শিশুকে সুরক্ষিত রেখে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের এসডিজি সমন্বয়ক সামিউর রহমান খান বলেন, শিশুশ্রমের জন্য দারিদ্র্য অনেকাংশে দায়ী। তবে স্কুলের অনাকর্ষণীয় পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও শিক্ষকদের কারণেও অনেক শিশু ঝরে পড়ে, কাজে যুক্ত হয়।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশু শ্রমিকদের চাহিদা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের চাইল্ড স্পনসরশিপ কর্মকর্তা নিশিতা ইসলাম। তিনি বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশুশ্রমিকদের চাহিদা কমাতে নিয়োগকর্তাদের সচেতন করা দরকার।