এসেছে দুই নতুন নন্দিনী
এই নন্দিনী উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র নয়। গোলাপের মতো দেখতে ভিনদেশি এক ফুল। আবার খাড়া পাতাসহ ডগা দূর থেকে অনেকটা টিউলিপের মতো দেখায়। দীর্ঘ গবেষণায় এক যুগ আগে এই দেশের জল–হাওয়ায় ফুলটি ফোটাতে সক্ষম হয়েছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন। তিনিই আদর করে এর নাম রেখেছেন ‘নন্দিনী’। এবার তাঁর তত্ত্বাবধানে নন্দিনীর নতুন দুটি জাত তৈরি করেছেন তাঁরই এক শিক্ষার্থী।
এই নতুন দুই প্রজাতির নন্দিনীর একটির রং গাঢ় নীল, অন্যটি হালকা গোলাপি। এর মধ্যে নীল নন্দিনীর নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু–১’ নামে। আর গোলাপি রঙেরটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু–২’।
নন্দিনী বাংলাদেশে ‘ইউস্টোমা’ নামেই বেশি পরিচিত। কেউ কেউ বলেন ‘লিসিয়েন্থাস’। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রকি পর্বত এলাকায় ইউস্টোমার উৎপত্তি। মেক্সিকো, ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর অংশের উষ্ণ অঞ্চলেও এই ফুল হয়। দেশের পুষ্প–অনুরাগীদের কাছে কদর থাকলেও দাম চড়া। চীন থেকে আমদানি করা একটি–দুটি ফুটন্ত ফুলসহ দু–তিনটি কলির দাম পড়ে এক শ থেকে দেড় শ টাকা। তবে দেশে এই ফুলের বাণিজ্যিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারলে দাম অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব।
নন্দিনী ফুলটি বুনো বৈশিষ্ট্যের। ঝড়, বৃষ্টি, প্রচণ্ড গরম বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ফুলের পাঁপড়ি অক্ষত থাকে। প্রতিটি ফুল শক্ত ডাঁটা বা বৃন্তের ওপর থাকে বলে কখনো বেঁকে যায় না কিংবা নুয়ে পড়ে না। একটানা ১৫ দিন পর্যন্ত ফুলটি অবিকল থাকে বলে দাম এত বেশি। ফুলদানির পানিতে সুক্রোজ (চিনি) মিশিয়ে ২৫ দিন পর্যন্ত তাজা রাখা যায়। ফুলের সঙ্গে চলে আসা কলিগুলো ঘরের স্বাভাবিক পরিবেশে ফুলদানিতেই কয়েক দিন পর সম্পূর্ণ ফোটে। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ফুলটি ফুটলেও সারা বছরই উৎপাদন সম্ভব। এর বৈজ্ঞানিক নাম Eustoma grandiflorum।
দুই দশক ধরে এই বিদেশি ফুল নিয়ে কাজ করছেন অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন। তিনি জাপান থেকে এর বীজ ও মাটি নিয়ে এসেছিলেন। সেই মাটিতে ২০০৭ সালে প্রথম ফুটেছিল ফুলটি। জামাল উদ্দিন মনে করেন, বাংলাদেশ নন্দিনীর বাণিজ্যিক উৎপাদনের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। বাণিজ্যিক উৎপাদনে সাফল্য এলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ফুলের পাশাপাশি বীজ ও চারা রপ্তানি করে বিদেশের বাজার ধরার সুযোগ আছে।
এই সম্ভাবনা থেকেই পিএইচডি গবেষণার বিষয় হিসেবে নন্দিনী ফুলকে বেছে নিয়েছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোছা. নাজনীন সুলতানা। তিনি বলেন, ‘গবেষণা কার্যক্রম শুরু করার আগে আমি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ফুলচাষিদের সঙ্গে কথা বলেছি। দেখেছি, তাঁদের গোলাপের প্রতি আগ্রহ আছে। কিন্তু গোলাপের চারা অল্প বৃষ্টিতেই নষ্ট হয়ে যায়। আর নীল গোলাপের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরদিনের। এ ক্ষেত্রে নীল নন্দিনী গোলাপের বিকল্প হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নন্দিনী একটি উন্নত মানের কাট-ফ্লাওয়ার। গাছ থেকে যেসব ফুল তুলে ঘর কিংবা মঞ্চ সাজানোর কাজে বেশি দিন ব্যবহার করা যায়, তা কাট-ফ্লাওয়ার। কিন্তু শীতের মৌসুম বাদে সারা বছর সেভাবে কাট–ফ্লাওয়ার উৎপাদিত হয় না। নন্দিনী সেই চাহিদা পূরণ করতে পারে।’
এদিকে নন্দিনীর বাণিজ্যিক উৎপাদনের সম্ভাবনা এত দিনেও বিকশিত না হওয়ার কারণ হিসেবে নাজনীন সুলতানার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বিশেষ ব্যবস্থায় ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নন্দিনীর চারা উৎপাদন করতে হয়, যা মাঠপর্যায়ে সম্ভব নয়। তিন বছর আগে আমরা একটা বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ২৫ জন ফুলচাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নন্দিনীর চারা সরবরাহ করেছিলাম। এতে চমৎকার ফল এসেছিল। কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে চারা উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচুর অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। যেটা আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি।’ তবে এই বাধা কাটিয়ে নন্দিনীর বাণিজ্যিক চাষাবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে—এমনই প্রত্যাশা পুষ্প–অনুরাগীদের।