সাঁতারে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন তাঁদের
>সাঁতার নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখলেও স্বপ্নজয়ে প্রধান বাধা সুযোগ-সুবিধা। তাঁরা এখন যে পুকুরটিতে সাঁতার চর্চা করছেন, সেখানে ওঠানামা খুবই কষ্টের।
রফিকুল ইসলামের বাড়ির পাশেই হাওরের বিশাল জলরাশির হাতছানি। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় সাঁতার কেটে পার করে দিতেন তিনি। সেই অভ্যাসে ছেদ পড়ে ১১ বছর আগে। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নষ্ট হয়ে যায় রফিকুলের। হুইলচেয়ার হয়ে ওঠে তাঁর নিত্যসঙ্গী। সাঁতার কাটার স্বপ্নটা ফিকে হয়ে যায়।
দেড় বছর ধরে আবার সাঁতার কাটতে শুরু করেছেন রফিকুল (৩২)। সাঁতার কেটেই জাতীয়, এমনকি বিশ্বমঞ্চে নিজের নাম উজ্জ্বল করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন তিনি। শুধু রফিকুল নন, তাঁর সঙ্গে আরও চার শারীরিক প্রতিবন্ধী এখন একই স্বপ্ন দেখছেন। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হিলোচিয়া ইউনিয়নের ইকরআটিয়া গ্রামে নিয়মিত তাঁরা সাঁতার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
১ জুন ইকরআটিয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় এই সাঁতার–যোদ্ধাদের সঙ্গে। আলাপচারিতায় জানা গেল তাঁদের নানা কষ্টগাথা আর কষ্ট জয়ের গল্প। রফিকুলের সঙ্গে সাঁতার কাটছেন প্রতিবন্ধী জসিম উদ্দিন (২৮), মো. হুমায়ুন (৩২), খায়রুল আলম (৩৫) ও মো. নাদিম (১৮)। রফিকুলের বাড়ি ইকরআটিয়া গ্রামে। হুমায়ুন একই উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের উজানচর গ্রামের আর জসিম হিলোচিয়া ইউনিয়নের পুড্ডা গ্রামের বাসিন্দা। খায়রুল আলম ও নাদিমের গ্রামের বাড়ি নিকলী উপজেলায়।
রফিকুল বলেন, সাঁতারে তাঁরা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ২০২০ সালে জাপানের টোকিওতে প্যারা অলিম্পিক প্রতিযোগিতা। তাতে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করা এখন তাঁদের লক্ষ্য।
২০০৯ সালের শুরুর দিকে প্রবাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের জীবন শুরু হুমায়ুনের। চিকিৎসা নিতে ২০১০ সালে ভর্তি হন সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি)। সেখানে হুইলচেয়ারে বসে গোলক নিক্ষেপ ও বাস্কেটবল খেলায় অংশ নিতেন তিনি। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি নেটওয়ার্ক আয়োজিত এক খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। তাতে ভারত, নেপাল ও মালয়েশিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশের বাস্কেটবল দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই দলে হুমায়ুনও ছিলেন। একই প্রতিযোগিতায় ভারোত্তোলনে তিনি হন তৃতীয়। এখন হুমায়ুনের সব স্বপ্ন সাঁতার নিয়ে।
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধীবান্ধব নয় বলে মনে করেন হুমায়ুন। তাঁর মতে, একজন প্রতিবন্ধীকে আরও প্রতিবন্ধী বানিয়ে রেখেছে এই রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা।
জসিম ছোটবেলায় গোল্লাছুট খেলায় পারদর্শী ছিলেন। এই খেলায় পারদর্শিতার কারণে গ্রামের মানুষের নজর কেড়েছিলেন তিনি। তাঁর দুরন্তজীবন থেমে যায় সাত বছর বয়সে টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর। সুস্থ হওয়ার পর চলাফেরা ও খেলাধুলা সবই করতে পারতেন। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে তিনি হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
জসিম বলেন, এই জীবন টেনে নেওয়া কঠিন। লোকজন কেমন করে যেন তাকায়। হাসিঠাট্টা করে। তখন কষ্ট লাগে। কিন্তু এখন পানিতে নেমে সাঁতার কাটছেন। নিজেকে কিছুটা যোগ্য মনে হচ্ছে। ইচ্ছা আছে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন তিনি।
জন্মের তিন বছরের মাথায় পোলিওতে আক্রান্ত হন খায়রুল আলম। এই রোগ তাঁর জীবনের স্বাভাবিকতা কেড়ে নেয়। হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে পারেন না। তবে পড়াশোনায় তিনি পিছিয়ে নেই। পদে পদে বাধা নিয়েই তিনি বিএ পাস করেছেন। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন স্থানীয় একটি দৈনিকে। এখন তিনি স্বপ্ন দেখছেন দক্ষ সাঁতারু হবেন। জন্ম থেকেই নাদিমের বাঁ হাতের তিনটি আঙুল নেই। কিন্তু সাঁতার নিয়ে তাঁর ভাবনার শেষ নেই এখন। নাদিম জানালেন, সুযোগ পেলে তিনি তা গ্রহণ করতে চান। সাঁতারে আন্তর্জাতিক পদক এনে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান, শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে জয় করা যায়।
পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাঁতার নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখলেও স্বপ্নজয়ে প্রধান বাধা সুযোগ-সুবিধা। তাঁরা এখন যে পুকুরটিতে সাঁতার চর্চা করছেন, সেখানে ওঠানামা খুবই কষ্টের। তা ছাড়া পুকুরটি ছায়াঘেরা। শীতকালে পানি খুবই ঠান্ডা থাকে। এককথায় সাঁতার কাটার মতো উপযুক্ত পরিবেশের অভাব রয়েছে। ফলে মাঝেমধ্যে লাগোয়া নিকলী উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের ভেতরের পুকুরে গিয়ে সাঁতার কাটতে হয়। এতে ব্যয় ও দুর্ভোগ দুটোই বাড়ে।
প্রতিবন্ধীদের এই দলটিকে সাঁতারে দক্ষ করে তোলার দায়িত্বে আছেন আবুল হাশেম। তিনি বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের প্রশিক্ষক। আবুল হাসেম জানালেন, প্রাথমিকভাবে এই পাঁচজনকে ফ্রি স্টাইল ও ব্যাকস্ট্রোক সাঁতারে দক্ষ করে তোলার চেষ্টা চলছে। পরে অন্যান্য সাঁতার শেখানো হবে।
সাঁতার নিয়ে এই পাঁচজনের অদম্য ইচ্ছা পূরণে সাহস জুগিয়ে চলেছে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেনস’।