মাতৃমৃত্যু এখনো বেশি, মানছে না সরকার
সর্বশেষ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ বলেছিল, ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে দেশে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। হারটি অনেক বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য ধামাচাপা দিয়ে পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়। পর্যালোচনাটি বলছে, জরিপের ফলাফল মাতৃমৃত্যু পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সরকার মাতৃমৃত্যুর দুটি প্রধান কারণ দূর করতে পারেনি।
কারণ দুটি হচ্ছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি। মাতৃমৃত্যুর ৫৪ শতাংশ ঘটে এ দুটি কারণে। পর্যালোচনা প্রতিবেদন বলছে, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই দুটি সমস্যা ও অন্যান্য জটিলতা মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট তৈরি নয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির ওষুধ সরবরাহে সরকারের তরফে উদ্যোগের ঘাটতি আছে।
বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ প্রথম হয়েছিল ২০০১ সালে। দ্বিতীয়টি হয় ২০১০ সালে। দেশি-বিদেশি গবেষণা ও দাতা প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা ও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে এ জরিপের গুরুত্ব আছে।
সর্বশেষ জরিপটি হয়েছিল ২০১৬ সালে। প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল ২০১৭ সালের শেষ দিকে। কিন্তু পর্যালোচনার কথা বলে দেড় বছর ধরে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশিত হচ্ছে না। অবশেষে মন্ত্রণালয়ের গঠিত উপকমিটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করেছে, যেটি উঁচু মাতৃমৃত্যু হারের তথ্যকেই সমর্থন করছে।
তবে এই পর্যালোচনা প্রতিবেদনের তথ্য ও বক্তব্য মানতে রাজি নন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং মাতৃমৃত্যু হার ১৭২। জরিপের তথ্য বাস্তবসম্মত নয়।
কমিটির আহ্বায়ক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (মেডিকেল শিক্ষা বিভাগ) পরিকল্পনা শাখার উপপ্রধান মো. আবদুস সালাম খান প্রথম আলোকে বলেন, সব সদস্যের স্বাক্ষর শেষে প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটিতে জমা দেওয়া হবে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে অগ্রগতি বোঝা যায়। আবার, কর্মসূচির দুর্বলতা শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। প্রতিবেদন চেপে রাখায় এর কিছুই করা যায়নি। মাতৃমৃত্যুর কারণ দূর না করে জরিপ প্রতিবেদন লুকিয়ে রেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের ও জাতির বড় ক্ষতি করেছে।
জরিপ ধামাচাপা
মাতৃমৃত্যু জরিপের মূল দায়িত্ব সরকারের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট)। নিপোর্টকে সহায়তা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সালের জরিপটির প্রাথমিক প্রতিবেদন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছিল ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ছাপা প্রতিবেদনটি বিলি করা হয়। নিপোর্টের ওয়েবসাইটে ১০৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি তুলে দেওয়া হয়।
প্রাথমিক ফলাফলে বলা হয়েছিল, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১ লাখ প্রসবে ১৯৬। এর আগের জরিপে অর্থাৎ ২০১০ সালে এ হার ছিল ১৯৪। অর্থাৎ মাতৃমৃত্যু কমেনি, বরং সামান্য হলেও বেড়েছে।
এরপরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জরিপের পদ্ধতি এবং প্রতিবেদনের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করে। তারা বলে, জরিপের তথ্য সঠিক নয়।
২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর নিপোর্ট ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলে। এ নিয়ে ১০ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তখন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমরা জরিপের তথ্য মানতে পারছি না।’ আর নিপোর্টের তৎকালীন মহাপরিচালক রওনক জাহান বলেছিলেন, তাঁরা জরিপ প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছেন।
এরপরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটি ১৪ সদস্যের একটি উপকমিটি করে। সদস্যদের মধ্যে নিপোর্টসহ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি যেমন ছিলেন, তেমনি বিবিএস বা আইসিডিডিআরবিসহ দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানেরও প্রতিনিধিত্ব ছিল। ডাক্তারদের সংগঠনের মধ্যে ছিল অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রাসঙ্গিক বিভাগ ও দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির প্রতিনিধিরাও ছিলেন।
পর্যালোচনা করে উপকমিটি বলেছে, জরিপ এবং মাতৃমৃত্যু শনাক্ত করার পদ্ধতি যথাযথ ছিল। মাতৃমৃত্যু সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় এমন বিভিন্ন উৎসের সঙ্গে জরিপের তথ্য সংগতিপূর্ণ। উৎসগুলোর মধ্যে আছে, বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) আর খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য বুলেটিন। পাশাপাশি কমিটি বর্ণনা করেছে কেন মাতৃমৃত্যু কমছে না।
সেবা আর ওষুধের ঘাটতি
পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন মাতৃস্বাস্থ্য সেবা দিতে পারছে না। কারণ, তাদের প্রশিক্ষিত জনবল, নির্দেশনাপত্র, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসাসামগ্রী নেই। ২০১৪ সালের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপের তথ্য উদ্ধৃত করে পর্যালোচকেরা বলেছেন, বেশির ভাগ স্বাভাবিক প্রসবসেবা প্রদানকারী কেন্দ্রগুলোতে সার্বক্ষণিক ধাত্রী পাওয়া যায় না।
কমিউনিটি ক্লিনিক বাদে মাত্র ৩ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে স্বাভাবিক প্রসবের প্রস্তুতি থাকে। উপজেলা ও তার ওপরের স্তরের প্রতিটি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, জরুরি প্রসূতিসেবা দেওয়া। কিন্তু বাধ্যতামূলক সব কটি সেবা জুগিয়ে কাজটি করছে এক-তৃতীয়াংশের সামান্য বেশি কিছু প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরেকটু খারাপ অথচ তারা প্রায় সবাই অস্ত্রোপচারে প্রসব করাচ্ছে।
চিকিৎসক ও গবেষকেরা বলছেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রশিক্ষিত জনবলের পাশাপাশি রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য অক্সিটসিন ও খিঁচুনি বন্ধের জন্য ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ইনজেকশন রাখার কথা। দুটি ওষুধেরই দাম কম এবং উৎপাদন যথেষ্ট। কিন্তু স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপে (২০১৪) দেখা গেছে, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অক্সিটসিন থাকে না। আর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কেন্দ্রেই ম্যাগনেশিয়াম সালফেট থাকে না।
অক্সিটসিন ও ম্যাগনেশিয়াম সালফেটের সরবরাহ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন। ১৩ মে দক্ষিণ খুলনার একটি উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ওষুধ দুটির সরবরাহ অনিয়মিত। সেদিন ওই উপজেলায় ওষুধ দুটি ছিল না, কিছুদিন আগে ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি) মো. শামসুল হক বলেন, এখন সব প্রতিষ্ঠানে ওষুধগুলোর নিয়মিত সরবরাহ আছে। খুলনার দক্ষিণের ওই উপজেলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা খবর নিচ্ছি।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস ম্যাগনেশিয়াম সালফেট পর্যাপ্ত উৎপাদন করে। প্রতি ইনজেকশনের দাম ২০ টাকা। তবে সরকার তাদের কাছ থেকে ওষুধ কেনে না।
করণীয় কী?
পর্যালোচনা কমিটি চারটি সুপারিশ করেছে। মোটা দাগে বললে, অত্যাবশ্যক মাতৃস্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে হবে, মাতৃমৃত্যুর মূল কারণগুলো ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে মান সেবা পদ্ধতি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বাস্থ্য খাতে সরকারের নেতৃত্ব ও নজরদারি শক্তিশালী করতে হবে।
২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে মাতৃমৃত্যু জরিপের ওপর নজর রাখছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদনের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দিতে হবে। নতুন তথ্য-উপাত্ত সবাইকে জানাতে হবে। পর্যালোচনা প্রতিবেদনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।