শেষ পর্যন্ত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হক ছুটিতে গেছেন। এতে শিক্ষার্থীরা উল্লাস করেছেন। শিক্ষার্থীদের আনন্দের কারণ, তাঁদের আন্দোলনের মুখে উপাচার্যকে ছুটিতে পাঠিয়েছে সরকার। এটা করে উভয় পক্ষকে ‘উইন উইন’ অবস্থার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
উপাচার্যকে দেড় মাস ছুটি দেওয়া হয়েছে মূলত তাঁর ‘সম্মান’ রক্ষার জন্য। তাঁর মেয়াদ শেষ ২৭ মে। এত দিন এই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলবে উপাচার্য ছাড়াই। এক অর্থে তাঁকে মেয়াদ শেষ করার সুযোগ দেওয়াই হলো। এই উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আওয়ামী লীগ-সমর্থক নীল দলের আহ্বায়ক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলায় আজ তাঁর এই দুর্গতি। অবশ্য দ্বিতীয় মেয়াদে যাতে তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য হতে না পারেন, সে জন্য বরিশালে সরকারদলীয় স্থানীয় রাজনীতিও এখানে কাজ করেছে বলে আলোচনা আছে।
গত প্রায় এক মাসের ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, এই লম্বা ছুটি কি একজন উপাচার্যের জন্য খুব সম্মানের? দেড় মাস ছুটিতে থেকে মেয়াদ পূরণ করার চেয়ে পদত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বস্তি ফিরিয়ে দেওয়া কি সবার জন্য মঙ্গলজনক হতো না?
এদিকে মেয়াদের শেষ সময়ে চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিতর্কিত নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে, নিয়মনীতি মেনে। কিন্তু দলীয় উপাচার্যরা সেখানে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিয়োগপ্রক্রিয়া কুক্ষিগত করে ফেলছেন।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট গত প্রায় চার বছরের। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমালোচনার মুখে দায়িত্ব পালন করে গেলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ‘চান ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি)। ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল ইউজিসির তদন্ত কমিটি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের অনিয়ম তদন্ত করতে যায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল কর্মকর্তা ও বহিরাগত যুবকের তাড়া খেয়ে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। এরপর ওই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি ইউজিসি।
আগামী জুনের প্রথম দিকে মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া সেই উপাচার্য অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নিয়োগ স্থগিত রাখতে বলেছে, তাতে কাজ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মেনে নিয়োগ বন্ধ রাখতে বলেছেন। কিন্তু রেজিস্ট্রার তা শোনেননি।
উপাচার্য অহিদুজ্জামান আবার দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ চান। আর চাইবেন না কেন? ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, উন্মুক্ত এবং জাতীয়সহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যরা তো দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন বা করেছেন। অহিদুজ্জামানের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধনও হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক রাজনীতি হওয়া উচিত আদর্শভিত্তিক। কিন্তু তা হয়ে গেছে লোভের রাজনীতি এবং তার সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দলীয় শিক্ষকদের পদ দিয়ে হাতে রাখা, তাঁকে কাজে লাগানোর চেষ্টা লক্ষ করা যায়। এ জন্য নীতি, আদর্শ বা আত্মসম্মানবোধ থাকা শিক্ষকদের অনেকেই এখন আর উপাচার্য হতে চান না।
দেখলেন, শিখলেন না
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জুনে। উপাচার্যের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে সেখানেও একের পর এক নিয়োগ চলছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে গত ডিসেম্বরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে ১৪২ জনকে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র এবং মামলার আসামিও রয়েছেন। গত মার্চ ও এপ্রিলেও অস্থায়ী (অ্যাডহক) এবং দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে অন্তত ২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নিয়োগ বন্ধ রাখার বিষয়ে ইউজিসির নির্দেশনা থাকার পরও কিসের ভিত্তিতে এসব কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা জানেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য শিরীণ আখতারও। বর্তমান উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন যখন বিশ্ববিদ্যালয়টির সহ-উপাচার্য ছিলেন, তখন তিনিও এ ধরনের নিয়োগের বিষয়ে কিছু জানতেন না। সব জানতেন তৎকালীন উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ। আর তখনকার সহ-উপাচার্য ইফতেখার ছিলেন কোণঠাসা।
২০১৩ সালের জুলাইয়ে অনিয়মের পাহাড় নিয়ে এবং পরের বছরের জুলাইয়ে উপাচার্য আনোয়ারুল আজিমের বিতর্কিত নিয়োগসহ নানা অনিয়ম প্রসঙ্গে প্রথম আলোয় দুই পর্বের প্রতিবেদন ছাপা হয়। ২০১৯ সালে এসে সেই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘প্রয়োজন ও সততা’র ভিত্তিতে সব নিয়োগ দিয়েছে বোর্ড।
ইফতেখার উদ্দিনের চলমান ভূমিকা বিশ্লেষণ করে ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’ প্রবাদ জুতসই মনে হয়। এখন নিজেই ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’-এ বসাসহ মেয়াদের শেষ পর্যায়ে যা করছেন, তা বিস্ময়কর বলছেন তাঁর সহকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের নিয়োগ বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি চিঠি দিলেও তা উপেক্ষা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে উপাচার্যদের ক্ষমতার উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, আইনের অপব্যবহার করে কেউ কেউ এমন নিয়োগ দিচ্ছেন। আইনপ্রণেতারা হয়তো ভাবেননি যে শিক্ষকেরাই আইনটির অপব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এখন সেই বিশ্বাস রাখা যাচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, আইন পরিবর্তন করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় বা উপাচার্যের ক্ষমতা খর্ব করার প্রসঙ্গ উঠবে।
অস্থিরতা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি বড় কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন চলছে। শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, অধিভুক্তিটা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এর মাধ্যমে অকারণে দুটি পক্ষকে মুখোমুখি করা হয়েছে। সব পক্ষের দাবিই যৌক্তিক।
গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের এক সহকারী অধ্যাপককে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন সেখানকার শিক্ষার্থীরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ওই শিক্ষককে বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। পাশাপাশি তাঁকে আট সেমিস্টারের একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। প্রশ্ন উঠেছে, যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হলে এমন লঘু শাস্তি হয় কীভাবে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তাও বলে দেওয়া উচিত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যরা বিদায় হচ্ছেন বিক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে। অনেকে বিদায় সংবর্ধনাও পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব অনিয়ম, অব্যবস্থা ও বঞ্চনার ঘটনাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে না। যেটুকু প্রকাশ পাচ্ছে, তাতেই লজ্জা পেতে হয়। প্রবীণ এই শিক্ষাবিদের মতে, তেমন কাউকে উপাচার্য করতে হবে, যিনি এই পদের যোগ্য এবং যাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও দায়িত্বজ্ঞান আছে। আসলে সরকারের কাছ থেকে নিয়োগ পেয়ে, সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কেউ কেউ যাচ্ছেতাই করায় এই পদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।