'ফণী'-আতঙ্কে রোহিঙ্গারা
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের পশ্চিম পাশে মধুরছড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির। এই শিবিরের উঁচু পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে আশ্রয়শিবিরটি। পাহাড়ের ঢালুতে সারি ধরে তৈরি হয়েছে ঘর। বর্ষার সময় ঢলের পানিতে বসতবাড়ি বিলীন হয়। ভূমিধসে তলিয়ে যায় ঘরবাড়ি। এখন ঘূর্ণিঝড় হলে কী হবে, তা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই রোহিঙ্গাদের।
মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের পাহাড়ি ঢালুতে পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে বসতি করছেন গোলচেহের খাতুন (৪৫)। তাঁর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলিবাজারে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাঁদের গ্রামে ঢোকে গুলি চালাতে থাকে। এ সময় আগুনে জ্বলতে থাকে রোহিঙ্গা বসতি। গুলিতে অনেকে সঙ্গে তাঁর স্বামীরও মৃত্যু হয়। এরপর ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন টেকনাফ। সেখান থেকে ঠাঁই হয় মধুরছড়ার এই ক্যাম্পে।
গোলচেহের খাতুন বলেন, এখানে থাকা-খাওয়া নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে ঘরটি বিলীন হলে মাথা গোঁজার ঠাঁই কোথায় পাব? দুই কিশোরী মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
এই শিবিরের আরেক বাসিন্দা সৈয়দ করিম (৩৪) বলেন, বলা হচ্ছে ৬-৭ নম্বর সতর্ক সংকেত পড়লে ক্যাম্পের সবাইকে বসতি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু ঘরের মালামাল রেখে কোনো রোহিঙ্গা কয়েক কিলোমিটার দূরের (উখিয়া-টেকনাফের) আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে রাজি হবে না। তা ছাড়া যেসব ঘরে গর্ভবতী ও বৃদ্ধা নারী কিংবা অসুস্থ লোকজন রয়েছে, তাদের পাহাড় থেকে নিচে নামানো-ওঠানো খুবই কঠিন কাজ। হাঁটা রাস্তা ছাড়া যানবাহন চলাচলের কোনো ব্যবস্থাও অধিকাংশ শিবিরে নেই।
উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গানেতা জাকির হোসেন বলেন, ‘গত দুই বছরে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় দেখেনি রোহিঙ্গারা। এখন ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানার কথা বলা হচ্ছে। আমরা যে যেভাবে পারি প্রস্তুতি নিচ্ছি। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রেডক্রস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দমকল বাহিনী, বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কর্মী বাহিনীর সঙ্গে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবীও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।’
মধুরছড়ার পাশের ক্যাম্প লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের কয়েকজন রোহিঙ্গা অভিযোগ করেন, সব আশ্রয়শিবিরে ৯০ শতাংশ বসতি পলিথিনের ছাউনিযুক্ত। অবশিষ্ট বসতি টিনের ছাউনি। ঘূর্ণিঝড়ে পলিথিনের ছাউনি উড়ে গেলে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু টিন উড়লে মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। এব্যাপারে লোকজনকে সতর্ক করা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশাসনের প্রস্তুতি আছে। ঘূর্ণিঝড় ফণী শনিবার সকালের দিকে উপকূলে আঘাত হানতে পারে। তার আগেই উপকূলীয় এলাকার লোকজনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হবে। বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফের শতাধিক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং হাজারখানেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে আনা হবে।
আশরাফুল আফসার বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা সব বেসরকারি সংস্থা এনজিও, জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), বিশ্ব খাদ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউএফপি) সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা তৎপর রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও জানমাল রক্ষার ক্ষেত্রে সেখানে ১০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, উপকূলে রেডক্রিসেন্টের প্রায় সাত হাজার স্বেচ্ছাসেবীর পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরগুলো আরও ১ হাজার ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাত হানার বিষয়সহ ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি ও মোকাবিলা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা রোহিঙ্গাদের ঘরেঘরে গিয়ে সতর্ক ও সচেতন করছেন।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৯৫১ জন। এর অন্তত সাত লাখ নারী ও শিশু। দুর্যোগ শুরু হলে নারী-শিশুদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুদ্দীন আহমেদ আজ বৃহস্পতিবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ধীর এগিয়ে আসলেও ফণী বেশ শক্তিশালী হয়ে গেছে। এখন তার গতি বেড়ে গেছে। তাই ফণী ৪ মের আগেও বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা এবং জানমাল রক্ষা নিয়ে গত চার দিনে দুবার বৈঠক করেছে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দুর্যোগঝুঁকিতে থাকা কয়েক লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সংগঠন, এনজিও সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।