'নিহত ব্যক্তিরাই দায়ী'
গাজীপুরের পুবাইলের ‘স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল’ কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে সাতজনের প্রাণহানির ঘটনায় দায়ের মামলার সাত আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, বিস্ফোরণের জন্য মামলার আসামিরা দায়ী নন, বরং যাঁরা ওই ঘটনায় নিহত হন, তাঁরাই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ছিলেন। অথচ দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মামলার সাত আসামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুবাইলের স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে সাতজন নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা করেছিল পুলিশ। সেই মামলায় ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। আদালত গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদনটি গ্রহণ করলে মামলা থেকে অব্যাহতি পান কারখানার মালিক-ব্যবস্থাপকসহ সাত আসামি। অথচ ঘটনার পর প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের গঠন করা দুটি তদন্ত কমিটিই কারখানার মালিক-ব্যবস্থাপকসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করেছিল। আসামিরা অব্যাহতি পাওয়ার পর কারখানাটি চালুও করা হয়। বিষয়টি গাজীপুর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরের নজরে আসে। পরে তাঁর নির্দেশে ১৯ এপ্রিল কারখানাটিকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি এটি সিলগালা করা হয়।
২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি ওই কারখানায় ৩০-৩৫ শ্রমিক কাজ করছিলেন। ওই দিন বিকেল চারটার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে বয়লার বিস্ফোরিত হলে তেলের ট্যাংকার ও কারখানায় আগুন ধরে যায়। পুরো কারখানা ভস্মীভূত হয়। এতে নিহত হন কারখানার ৫ শ্রমিক এবং কারখানার সামনের সড়কে থাকা রিকশার এক চালক ও আরোহী আরেক স্কুলশিক্ষিকা। আহত হন অনেকে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান গাজীপুরের জেলা প্রশাসক। ওই দিন রাতেই জেলা প্রশাসন অগ্নিকাণ্ডের কারণ এবং দায়ীদের শনাক্ত করতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান এবং শিল্প পুলিশের সহকারী পরিচালক ও ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালককে সদস্য করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা জেলা সহকারী পরিচালককে প্রধান করে তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটিই দুর্ঘটনার জন্য ওই সাতজনকে দায়ী করে। তাঁরা হলেন কারখানার মালিক পুবাইলের বসুগাঁও এলাকার ইমান উদ্দিন, জমির মালিক বাছেদ ব্যাপারী, কারখানার ব্যবস্থাপক মো. শাহীন (৩৫), কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের সাবেক উপমহাপরিদর্শক মো. সহিদুল ইসলাম, তৎকালীন উপমহাপরিদর্শক ফরিদ আহমেদ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুরের তৎকালীন উপপরিচালক সোনিয়া সুলতানা এবং পুবাইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে কারখানাটি পরিচালনা করার পরও ব্যবস্থা না নেওয়ায় সহিদুল ইসলাম, ফরিদ আহমেদ ও সোনিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা এবং কারখানা ও জমির মালিক, ব্যবস্থাপক ও সুলতান উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলো।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, কারখানার মালিক কোনো প্রকৌশলীর নকশা ছাড়াই স্থানীয়ভাবে লোহার পাত দিয়ে বয়লার প্রস্তুত করে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চালাচ্ছিলেন। অবৈধ কারখানার জন্য জমি ভাড়া দিয়ে জমির মালিকও অপরাধ করেছেন। ব্যবস্থাপক মালিকের নির্দেশে ঝুঁকিপূর্ণ বয়লারটি চালিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। আর সুলতান উদ্দিন আহমেদ যথাযথ নিয়ম না মেনে ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে অবৈধ কারখানা পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছেন।
দুর্ঘটনায় নিহত কারখানার নিরাপত্তাপ্রহরী আবদুল কাদেরের প্রতিবেশী শফিক মোল্লা বলেন, দুর্ঘটনার পর স্থানীয় মানুষ ও নিহতদের স্বজন এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন কারখানার মালিকসহ দায়ীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। কিন্তু পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি। পরবর্তীকালে সব দাবি অগ্রাহ্য করে এবং তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তোয়াক্কা না করে আসামিদের নির্দোষ উল্লেখ করে গোপনে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। আদালত পুলিশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আসামিদের খালাস দিয়েছেন।
সম্প্রতি স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ১০-১২ ফুট উঁচু টিনের বেড়া দিয়ে চারদিক ঘিরে রাখা হয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, কারখানার মূল ফটক ২৪ ঘণ্টাই বন্ধ থাকে। ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। বহু ডাকাডাকির পর নুরুল হক পরিচয়দানকারী এক নিরাপত্তাপ্রহরী জানান, ইমান উদ্দিনের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বর্তমানে কারখানাটি চালাচ্ছেন।
নিহত রিকশাচালক স্বাধীন মিয়ার ছেলে আরিফ হোসেন (২২) বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম, কারখানার মালিক গ্রেপ্তার হবে, তাঁর বিচার হবে। একটি দুটি নয়, সাতজন মানুষ পুড়ে মরল, কিন্তু তাঁদের কিছুই হলো না।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মোবারক হোসেন বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় মালিক বা কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল না। যাঁরা কর্মরত ছিলেন এবং মারা গেছেন—তাঁদের অবহেলার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। বয়লারের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে বিস্ফোরণ হতো না। তাই তাঁদের বাদ দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের স্থানীয় ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোমেন মিয়া বলেন, গোপনে কারখানাটি চলছিল। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানানোর পর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ১৯ এপ্রিল ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে কারখানা সিলগালা করে দেন।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, অনুমোদন ছাড়া কারখানা পরিচালনার সুযোগ নেই। বিষয়টি জানার পর কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।