২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

১২০০ কোটি টাকা গচ্চা

যশোর সদরের পাঁচবাড়িয়া এলাকায় গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের টাউন  বর্ডার স্টেশন।  ছবি: প্রথম আলো
যশোর সদরের পাঁচবাড়িয়া এলাকায় গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের টাউন বর্ডার স্টেশন। ছবি: প্রথম আলো
>

• পাঁচ জেলায় গ্যাস দিতে ‘অবাস্তব’ দুটি প্রকল্প
• প্রকল্পের কাজ চলেছে ৪ সরকারের আমলজুড়ে
• প্রথমে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সঞ্চালন লাইন
• পরে আরও ৬০০ কোটি টাকার বিতরণ প্রকল্প
• পাঁচ জেলায় বিতরণের মতো পর্যাপ্ত গ্যাস নেই

খুলনা, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলায় গ্যাস সরবরাহের জন্য গত চারটি সরকার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু ১৪ বছরেও ওই এলাকায় গ্যাস যায়নি। এখন গ্যাস সরবরাহের প্রকল্পই বাদ দেওয়া হয়েছে।

সরকার টাকাটা খরচ করেছে দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে—বড় পরিসরে শিল্প-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়ে। প্রথমে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। পরে আরও ৬০০ কোটি টাকার একটি বিতরণ প্রকল্প নেওয়া হয়। ওই প্রকল্পে ৩৫০ কোটি টাকা দিয়ে বিতরণ লাইনের সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

সরঞ্জামগুলো বিনা ব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে। আধখেঁচড়া প্রকল্পটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে শেষ বলে ঘোষণা করেছে। এমনিতেও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় সঞ্চালন লাইনের উৎসে এই পাঁচ জেলায় বিতরণের মতো পর্যাপ্ত গ্যাস নেই।

তবে পেট্রোবাংলার একটি তদন্ত কমিটি গত বছর বলেছে, বিতরণ লাইন নির্মিত হলে অন্তত তিনটি জেলায় গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হতো। এতে কিছুটা হলেও খরচ করা টাকা উশুল হতো। এখন পুরো টাকাই পানিতে গেছে। এই পাঁচ জেলা হলো কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট। আপাতত এসব জেলায় গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা নেই সরকারের।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ-উজ জামান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এ অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু গ্যাস না থাকায় একসময়ের শিল্পনগরী খুলনা প্রাণ ফিরে পায়নি, সাধারণ মানুষ হতাশ হয়েছে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নির্বাচনের নির্ধারিত বছর সামনে রেখে ২০০৫ সালে সঞ্চালন লাইনের প্রকল্প নিয়েছিল। এখন বিএনপির খুলনা মহানগর কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের দরকার নেই। অন্তত বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পকারখানায় গ্যাস দেওয়া হোক। গ্যাস পেলে মৃত শিল্পনগরী প্রাণ ফিরে পাবে।

সঞ্চালন লাইনের কাজ শুরু হয় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ছিলেন অধ্যাপক ম তামিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যখন এ দুটি প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়, তখন সরকার জানত গ্যাস পাওয়া যাবে না। সেটি জেনেও অত বড় একটি প্রকল্প নেওয়া উচিত হয়নি। এতে পাইপলাইন স্থাপিত হয়েছে, বিতরণ সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, কিন্তু গ্যাস যাচ্ছে না। আপাতত যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই।

সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে তখন ম তামিমের কিছু করণীয় ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পগুলো আগে নেওয়া হয়েছিল। আমরা তখন জোর করে তা বন্ধ করতে পারতাম। কিন্তু এডিবির (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ঋণে এটি করা হচ্ছিল। প্রকল্প বন্ধ করা হলে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া হতো।’

বিতরণ প্রকল্পটিও এডিবির ঋণনির্ভর। এটি নিয়ে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ২০১৭ সালে একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়েছিল, উৎস পাইপলাইনে গ্যাসের প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এবং প্রকল্প প্রস্তাবে বলা গ্যাসের মজুত নিয়ে কোনো জরিপ না থাকার পরও ‘অবাস্তব পরিকল্পনা’ করে ‘দায়িত্বহীন’ একটি প্রকল্প প্রস্তাব দিয়ে মন্ত্রণালয় ও কমিশনকে ‘মিসগাইড’ করা হয়েছে। যাঁরা এ কাজ করেছেন, আইএমইডি তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলে। এরপর গত বছরের এপ্রিলে পেট্রোবাংলা বিতরণ প্রকল্প নিয়ে তদন্ত করে।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আইয়ুব খান চৌধুরী গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিবেদন জমা দেন। সেটা গত মার্চে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করে পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্যাসের প্রাপ্যতার যে ধারণা করা হয়েছিল, তার তুলনায় গ্যাসের বিপুল ব্যবহারের হিসাবটি একেবারেই সামঞ্জস্যহীন ছিল। তবু অগ্রাধিকার ঠিক করে বিতরণ প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন করলে অন্তত তিনটি জেলায় গ্যাস দেওয়া যেত। বিনিয়োগ করা ৩৫০ কোটি টাকা থেকে কোনো আয় হয়নি। উল্টো গত অর্থবছর নাগাদ এডিবির ঋণের সুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি টাকা।

কমিটি আরও বলেছে, বিতরণ লাইনের জন্য কেনা পাইপ ও অন্যান্য সরঞ্জাম খুলনার তিনটি স্থানে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। অনেক সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেছে। বাস্তবায়নকারী সংস্থা সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিসিএল) রূপসা নদীর দুই পাশে পাইপলাইন বসায়নি অথচ নদীর তলদেশে পাইপলাইন করেছে বলে জানিয়েছে।

তদন্ত কমিটি এসজিসিএলের তৎকালীন সাতজন কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে। তাঁরা হলেন প্রকল্প সমন্বয়ক কামাল উদ্দিন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), তৎকালীন ব্যবস্থাপক এ এস এম আকবর কবীর (বর্তমানে বিজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক), প্রকল্প পরিচালক এস এম রেজাউল ইসলাম (অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে), উপব্যবস্থাপক কাজী আনোয়ারুল আজিম (বর্তমানে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের উপমহাব্যবস্থাপক এলএনজি শাখা), ব্যবস্থাপক রানা জাকী হোসেন (উপব্যবস্থাপক বিজিডিসিএল), সহকারী প্রকৌশলী আবু বকর (পেট্রোবাংলার ব্যবস্থাপক, এলএনজি শাখা) ও সহকারী ব্যবস্থাপক (ক্রয়) শেখ মো. এজাজ (চাকরি ছেড়ে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায়)।

কাজী আনোয়ারুল আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের প্রকল্প করতে বলা হয়েছে, আমরা করেছি। এর বেশি কিছু জানি না।’ এদিকে বিতরণ প্রকল্পের ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি নিয়ে পেট্রোবাংলা একটি তদন্ত করেছে। কিন্তু সঞ্চালন পাইপলাইনের পেছনে ৮৫০ কোটি টাকা গচ্চার বিষয়ে কোনো তদন্তই হয়নি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলমের আক্ষেপ, জনগণের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা পানিতে গেছে, অথচ এর জন্য কাউকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।

এই দুই প্রকল্পের প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা যাবে কি? বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বললেন, ‘বিতরণ প্রকল্পের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পেয়েছি। যাঁরা এ ঘটনায় যুক্ত, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। আর সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়েও তদন্ত করা হবে।’

পেট্র্রোবাংলা বলেছে, তারা বারবার বলা সত্ত্বেও বিতরণ প্রকল্প প্রস্তাবটি সংশোধন করা হয়নি। প্রকল্প চলাকালীন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ছিলেন হোসেন মনসুর। তাঁর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদই প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন করে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের এই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে গ্যাস প্রাপ্তির নিশ্চয়তাই নেই, সেখানে এত বড় প্রকল্প কীভাবে নেওয়া হলো, সেটাই বড় প্রশ্ন।

বিতরণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল এসজিসিএল। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুষ্টিয়া-খুলনা গ্যাস বিতরণ প্রকল্প সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’

আর সঞ্চালন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সরকারের গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। জিটিসিএলের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক, বর্তমানে জিটিসিএলের উপব্যবস্থাপক মো. আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের কাজ ছিল বাস্তবায়ন। পাইপলাইনটিতে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হয়নি গ্যাসের অভাবে। এর জন্য তো আমরা দায়ী নই।’

বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সঞ্চালন প্রকল্পটি নেওয়ার সময় জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বিএনপির নেতা এ কে এম মোশাররফ হোসেন। তাঁর বিরুদ্ধে কানাডীয় কোম্পানি নাইকো রিসোর্সকে কাজ পাইয়ে দিয়ে অর্থ নেওয়ার অভিযোগে মামলা চলছে। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

সঞ্চালন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। শেষ হয় গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৫ সালে। এর আগে ২০০৯ সালে একই দলের সরকার বিতরণ প্রকল্পটি অনুমোদন করে। সেই সময় জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) এনামুল হক। গ্যাস সরবরাহ করা যাবে না জেনেও কেন এ দুটি প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। কারণ, জ্বালানির সব সিদ্ধান্ত দিতেন উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।’

১০ এপ্রিল এই প্রতিবেদক তৌফিক-ই-ইলাহীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালে তিনি কোনো জবাব দেননি।

সাবেক বিদ্যুৎ-সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের মতে, রাস্তা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস দেওয়ার ওয়াদা দেশের নির্বাচনী রাজনীতির সংস্কৃতি। এরই সৌজন্যে প্রকল্প দুটির জন্ম ও লালন-পালন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এককালের শিল্পনগরী খুলনায় বেকারত্ব আর কারখানা বন্ধের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। বেফায়দা প্রকল্প দুটি নেওয়ার পেছনে এসব বিবেচনা কাজ করেছে। তবে এমন প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার আগে এডিবির আরও ভাবা উচিত ছিল। আর অনুমোদনের কারিগরি বিষয় যাঁরা দেখেছেন, তাঁদেরও দায় আছে।