কুষ্টিয়ায় বর্জ্য থেকে তৈরি জৈব সার
বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে জৈব সার। এসব সার বাজারজাত করা হচ্ছে। সবজি ও ফুল চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে। দুই বছর ধরে কুষ্টিয়া পৌরসভা কঠিন বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য থেকে এ জৈব সার উৎপাদন করে আসছে। কৃষি গবেষকেরা বলছেন, রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈব সারের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই সার জমির উর্বরতা শক্তি ও পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায় এবং পরিবেশবান্ধব। জৈব সার ব্যবহারে মাটির গুণগত মান টেকসই হচ্ছে।
পৌরসভা সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে শহরের বারাদি এলাকায় প্রথম কম্পোস্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। শুরুতে কম্পোজিট প্রক্রিয়ায় শুধু কঠিন বর্জ্যের জৈব অংশ (রান্নাঘর ও কাঁচাবাজারের বর্জ্য) ব্যবহার করা হতো। পরে ২০১২ সালে পয়োবর্জ্যকে ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা হয়। পয়োবর্জ্য ও কঠিন জৈব বর্জ্যের মিশ্রণে কম্পোস্ট প্ল্যান্টে জৈব সার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এরাস নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জৈব সার উৎপাদনে চুক্তি করে। পৌরসভার সহযোগিতায় এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্ল্যান্ট এলাকায় কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে প্রতিষ্ঠানটি জৈব সার উৎপাদনে যায়। কম্পোস্ট প্ল্যান্টে প্রতিদিন প্রায় ২ টন জৈব বর্জ্য ও ৯ হাজার লিটার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয়েছে। ১২টি কম্পোজিট বক্স, দুটি ড্রাইং বেড এবং একটি কোকোপিট ফিল্টার রয়েছে। শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে মাঠের মধ্যে প্রায় ৯ একর জায়গায় প্ল্যান্টটি অবস্থিত।
পৌরসভার তত্ত্বাবধানে ৩৬টি ভ্যানের মাধ্যমে পৌরসভার ১৪টি ওয়ার্ডের বাসাবাড়ি ও কাঁচাবাজার থেকে কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়, যার বেশির ভাগই তরকারিজাতীয় বর্জ্য। এ ছাড়া তিনটি ভ্যাকুটাগের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংক থেকে পয়োবর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্রে কঠিন জৈব বর্জ্য ও পয়োবর্জ্যকে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিশোধনের মাধ্যমে জৈব সারে রূপান্তর করা হয়। সংগ্রহ করা পয়োবর্জ্য শুকানোর জন্য দুটি ড্রাই বেড আছে। অপরিশোধিত পানি কোকোপিট ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশোধন করা হয়। পয়োবর্জ্য শুকানোর জন্য অন্তত সাত দিন অপেক্ষা করতে হয়। প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ হাজার শুকনো পয়োবর্জ্য হয়। এরপর শুকনো পয়োবর্জ্য ও পচনশীল বর্জ্য কো-কম্পোস্টিংয়ের জন্য কম্পোস্ট চেম্বারে স্তরে স্তরে স্থাপন করা হয়। ১২টি কম্পোস্ট চেম্বারে অন্তত ৫০ দিন রাখার পর জৈব সার পাওয়া যায়।
পৌরসভা ও এরাসের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে পৌরসভার পয়োবর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট এবং কম্পোস্ট প্ল্যান্ট পরিচালনার মাধ্যমে আপ্রকাশি নামে একটি প্রতিষ্ঠান জৈব সার বিপণন করছে। প্রতি মাসে গড়ে ১০ থেকে ১২ টন জৈব সার উৎপাদিত হচ্ছে। গড়ে প্রায় ছয় টন বিক্রয় হচ্ছে। ফুল চাষের জন্য এ জৈব সার যশোরের গদখালীসহ চট্টগ্রামে যাচ্ছে। এ ছাড়া রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবজি ও আমবাগানে এই সার বিক্রি হয়। ১ কেজি, ৫ কেজি ও ৪০ কেজির প্যাকেট করা হয়। প্রতি কেজি সারের দাম ১২ থেকে ১৫ টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) গবেষণায় দেখে গেছে, এ জৈব সারে কোনো ক্ষতিকারক জীবাণু নেই। সবজি, যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, ঢ্যাঁড়স ও মিষ্টিকুমড়া, গ্ল্যাডিওলাস ও গাঁদা ফুল চাষে এই জৈব সার প্রয়োগে কৃষিজমিতে পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদন লাভজনক হয়েছে। জমিতে ব্যবহার করলে মাটি বিষাক্ত হয় না। মাটির গুণ বেড়ে যায়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদ প্রযুক্তি বিভাগ গবেষণায় পেয়েছে, শুকনা পয়োবর্জ্য ও মাছের খাদ্যের সংমিশ্রণে মাছের খাদ্য হিসেবে প্রয়োগ করা যায়। এই জৈব সার মাছ চাষের পুকুরে প্রয়োগের ফলে পানিতে প্লাঙ্কটনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। তেলাপিয়া মাছের লাভজনক উৎপাদিত হয়।
শহর-পরিকল্পনাবিদ রানভীর আহমেদ বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ কাজ চলমান থাকবে। কুষ্টিয়া পৌরসভার এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সারা দেশে পরিবেশবান্ধব কৃষির বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এরাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার বিন রসুল বলেন, জৈব সার মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায় ও পোকামাকড় থেকে ফুল ও ফসলকে মুক্ত করতে সক্ষম। কৃষকদের মধ্যে এ বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট যশোর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সরেজমিন গবেষণা বিভাগ) কাওছার উদ্দিন আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর ধরে কুষ্টিয়া পৌরসভা প্ল্যান্টে বেশ কয়েকবার গিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এই জৈব সার খুবই ভালো। বিশেষ করে গ্লাডিওলাস ও গাঁদা ফুল উৎপাদন এবং বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির অধিক ফলনে খুবই উপকারী।
কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী বলেন, পৌরবাসীর উন্নয়নেই পয়োবর্জ্য দিয়ে পরিবেশবান্ধব জৈব সার তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। তিনি নিজেও এই জৈব সার সবজি উৎপাদন ও ফুলবাগানে ব্যবহার করছেন। সবজির ফলন বেশি ও খেতে অনেক সুস্বাদু। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা পেলে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আরও বেশি কার্যকর করা সম্ভব।
জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মাধ্যমে সার তৈরি করে তা বাজারজাত করছে, এটা অনেক বড় ব্যাপার। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার জন্য প্রশাসন থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।