মিলন মিয়া এখন নিজেই চাকরি দেন

খামারে গাভিকে খাওয়াচ্ছেন গাইবান্ধার উত্তর হাটবামুনি গ্রামের মিলন মিয়া।  প্রথম আলো
খামারে গাভিকে খাওয়াচ্ছেন গাইবান্ধার উত্তর হাটবামুনি গ্রামের মিলন মিয়া। প্রথম আলো
>

* বেকার থেকে উদ্যোক্তা
* চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছিলেন, কিন্তু পাননি
* এখন গরু ও সমন্বিত কৃষি খামার করে ভাগ্য বদলে গেছে তাঁর

স্নাতকোত্তর পাস করার পর একটি চাকরি পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। চাকরির জন্য অসংখ্য মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আর চাকরি হয়নি। এতে হতাশ হননি। আয়ের পথ খুঁজতে থাকেন। অবশেষে পেয়েও যান। প্রথমে প্রশিক্ষণ নিয়ে গরুর খামার গড়ে তোলেন। পরে সমন্বিত কৃষি খাবার। এতে ভাগ্য বদলে গেছে তাঁর। তিনি এখন আর চাকরি খোঁজেন না; বরং বেকারদের চাকরি দেন।

এই পরিশ্রমী ও সাহসী ব্যক্তির নাম মিলন মিয়া। বয়স ৪০ পেরিয়েছে অনেক আগেই। বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার অনদানগর গ্রামে। দুই খামার থেকে মাসে তিনি সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০ হাজার টাকা আয় করেন। নিজ বাড়ি পীরগাছায় হলেও তিনি খামারগুলো গড়ে তুলেছেন গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুরুটা একদমই ভালো ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের এই শক্তিশালী অবস্থানে এসেছেন মিলন মিয়া। ২০০৫ সালে নিজ বাড়ি পীরগাছা উপজেলার অনদানগর গ্রামে গাভি পালন শুরু করেন। ছোট্ট আকারে গাভির খামার গড়ে তোলেন। কিন্তু মূলধনের অভাবে কয়েক বছর পর সেই খামার বন্ধ হয়ে যায়। পরে মামা গোলাম রব্বানীর সহায়তায় পুনরায় গাইবান্ধার উত্তর হাটবামুনি গ্রামে গরুর খামার দেন তিনি।

সম্প্রতি মিলন মিয়ার সঙ্গে তাঁর খামার শুরু করার বিষয়ে কথা হয়। তিনি তাঁর ব্যবসা শুরুর গল্পটা বললেন এভাবে: সাদুল্যাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত উত্তর হাটবামুনি গ্রাম। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। প্রথমে ছয়টি ফ্রিজিয়ান জাতের গাভি দিয়ে খামার শুরু করা হয়। খামারের জন্য উত্তর হাটবামুনি গ্রামে নয় বিঘা জমি বেছে নেন। এর মধ্যে প্রায় দুই বিঘায় গাভির শেড নির্মাণ করেন। খামারের নাম দেন ডিজনি ডেইরি ফার্ম। প্রথমে ছয়টি গাভি দিয়ে শুরু।

এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাঁর ব্যবসার খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানালেন, বর্তমানে তাঁর ১৩টি গাভি ও ৯টি বাছুর রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি গাভি দুধ দেয়। দৈনিক ১১২ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। স্থানীয় বাজারে প্রতি লিটার দুধ ৩৮ টাকা। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার ৫০০ টাকার দুধ বিক্রি করেন। দৈনিক গাভির খাদ্য ও মজুরির জন্য ৩ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয় হয়। দৈনিক দুধ বিক্রি করে আয় ৯০০ টাকা। মাসিক ২৭ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। দৈনিক উৎপাদিত দুধের অর্ধেক স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। অর্ধেক বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ডেইরি প্রকল্প আড়ং দুধ নিয়ে যায়। এ ছাড়া প্রতিবছর একটি করে বাছুর বিক্রি করা হয়। এ থেকে বার্ষিক ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, খামারের গোবর থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে বায়োগ্যাস। এই বায়োগ্যাস দিয়ে খামারের শ্রমিকসহ আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে দৈনিক রান্নার কাজ হচ্ছে। বায়োগ্যাসের উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে জৈব সার তৈরি হচ্ছে। এসব জৈব সার নিজের কৃষিজমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত জৈব সার বিক্রি করে বেশ আয় হচ্ছে। এ ছাড়া তিনজন শ্রমিক খামারে চাকরি করছেন। এতে তাঁদের কর্মসংস্থান হয়েছে।

আয়ের বিভিন্ন উৎস সৃষ্টির বিষয়ে মিলন মিয়া বলেন, সমন্বিত খামারে শুধু দুধ ও বাছুর থেকেই আয় হচ্ছে না। গাভির খাবারের জন্য খামারে প্রায় তিন বিঘা জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষ করা হয়েছে। ঘাস বিক্রি করেও আয় হচ্ছে। এ ছাড়া খামারের এক বিঘায় পেঁপে, এক বিঘায় মিষ্টিকুমড়া ও দুই বিঘায় লিচু ও আমবাগান করা হয়েছে। আমের মুকুল এসেছে। এবার আম বিক্রি করেও তাঁর অনেক টাকা আয় হবে। খামারের নেপিয়ার ঘাস, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া ও জৈব সার বিক্রি করেও মাসিক ১২ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।

মিলন মিয়ার সমন্বিত কৃষি খামারের তদারকি করছেন কামারপাড়া ইউনিয়নের উত্তর হাটবামুনি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহজাহান মিয়া। তিনি বলেন, সমন্বিত কৃষি খামার প্রতিষ্ঠায় মিলন মিয়াকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিদিন তাঁকে নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা এবং বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

বেকার যুবকদের চাকরির পেছনে না ঘুরে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মিলন মিয়া বলেন, ‘২০০১ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেছি। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি পাইনি। কিন্তু আমি হতাশ হইনি। চাকরির পেছনে না ঘুরে পরিশ্রম করে এ অবস্থায় এসেছি।’ ভবিষ্যতে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে বড় আকারে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।

মিলনের মামা গোলাম রব্বানী বলেন, ‘চাকরি ছাড়াও নিজের প্রচেষ্টায় সমন্বিত খামার স্থাপন করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, তার প্রমাণ মিলন মিয়া। তাই তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছি।’