তাসিনের জন্য কেউ দাঁড়ায়নি
রাজধানীর বারিধারাসংলগ্ন নদ্দার অলিগলি পেরিয়ে জোয়ার সাহারা বাজার এলাকায় অলিপাড়ার নির্ধারিত বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। ফোন করে যাওয়ার কারণে বাসায় অপেক্ষায় ছিলেন আহসান উল্লাহ। বড় ছেলেকে সামনে ডেকে এনে পরিচয় করালেন। ছোট ছেলেকে এভাবে পরিচয় করানোর সুযোগ নেই। সোফার ফ্রন্ট টেবিলের নিচের পাটাতন থেকে উল্টে রাখা কয়েকটি ছবি বের করে বললেন, ‘ও তাসিন।’ ছবিগুলো দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেলেছেন। কারণ, তাসিনের মা ছেলের অনুপস্থিতির কষ্ট মেনে নিতে পারছেন না। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মায়ের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ছবিগুলো।
আহসান উল্লাহকে বললাম, ‘প্রথম আলোর পাঠক মন্তব্যের অপশনে ছেলের জন্য সুবিচার চেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন আপনি।’
আহসান উল্লাহ বললেন, ‘হ্যাঁ, এ পর্যন্ত প্রশাসনের ১৬ জায়গায় চিঠি পাঠিয়েছি। সব কয়টি গণমাধ্যমের কাছে আবেদন জানিয়েছি। কেউ সাড়া দেয়নি। ক্ষোভে-দুঃখে কমেন্ট করেছিলাম আবরারকে (১৯ মার্চ যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসচাপায় নিহত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী) নিয়ে প্রকাশিত প্রথম আলোর খবরে। তাও ভালো প্রথম আলো তো অন্তত যোগাযোগ করল।’
‘তাসিনের ঘটনাটি বলুন।’
ছেলের কথা বলতে শুরু করলেন আহসান উল্লাহ। মোহাম্মদপুরের সেন্ট জোসেফের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল আদনান তাসিন (১৭)। গত ১১ ফেব্রুয়ারি কলেজ থেকে অলিপাড়ার বাসায় ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয় সে। জোয়ার সাহারার কাছে শেওড়া রেলগেটের সামনে জেব্রাক্রসিং দিয়ে পার হওয়ার সময় বাসচাপায় নিহত হয় মাত্র কৈশোর পেরোনো তাসিন। ২০০২ সালে বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর জন্ম নিয়েছিল। বড় হয়ে হতে চাইত সেনা কর্মকর্তা। এই তো মৃত্যুর ৪১ দিন আগে বাবা, মা ও ভাইয়ের সঙ্গে সোফায় বসে ছোট্ট একটি কেক কেটে শেষ জন্মদিন উদ্যাপনের সুযোগ পেয়েছিল। একটি বাস তার সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন থামিয়ে দিয়েছে।
তাসিনের বাবা জানালেন, একটি পোশাক কারখানায় তিনি সোর্সিং ও মার্চেন্ডাইজিং ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করতেন। ২০১৭ সালে জিবিএস ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এখন কিছুটা চলাচল করতে পারলেও পুরোপুরি সুস্থ নন। কারও সাহায্য ছাড়া বাইরে চলাচল করতে পারেন না। তাসিনের বন্ধু ছিল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ওই দিন বেলা দেড়টা-দুইটার দিকে উত্তরা পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব ১১-৪৫৮৪) একটি বাস তাসিনকে চাপা দেয়। ওই বন্ধু আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় কাছাকাছি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে বেলা তিনটার দিকে তাসিনের বন্ধু তাঁকে ফোন দিয়ে জানান, তাসিন দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে কিছুটা আহত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাসিনের বড় ভাই আদনান সামিন (১৮) বাসা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। পিছু পিছু তাঁর মাও যান। তিনি বাসায় বসে ছটফট করছিলেন আর অবিরাম ফোন করে চলছিলেন ছেলে সামিন, স্ত্রী ও তাসিনের বন্ধুকে। একবার তাসিনের সঙ্গেও কথা হয়।
হাসপাতালে গিয়ে বড় ছেলে সামিন দেখতে পান, বারান্দায় একটি স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে তাসিনকে। এ ধরনের গুরুতর আহত কাউকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই জানিয়ে তাসিনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন সেখানের চিকিৎসকেরা। অ্যাম্বুলেন্সে করে তাসিনকে নিয়ে রওনা দেওয়ার সময় বনানীর কাছে প্রচণ্ড যানজটে পড়েন তাঁরা। তাসিনের অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে না নিয়ে বনানী কবরস্থান সড়কে অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে কাছাকাছি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যান তাঁরা। সেখানে রাত আটটার সময় তাসিনকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
আহসান উল্লাহ যখন ছেলের কথা বলছিলেন, তখন পাশেই ড্রয়িংরুমসংলগ্ন ডাইনিং টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে ছিলেন মা শাহিদা আক্তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ শাহিদা নিজেই পড়াতেন ছেলেদের। মেধাবী দুই ছেলের কখনো অন্য কোনো শিক্ষক বা প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন হয়নি। চুপচাপ তিনি শুধু কথা শুনে যাচ্ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
আহসান উল্লাহ বললেন, ‘সব সময় গর্ব করে বলতাম, আমার দুই ছেলে আমার অ্যাসেট (সম্পদ)। কতজন যে বলতেন, এক বাসায় এমন মেধাবী দুই ভাই! সামিন তো পড়ালেখায় কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। আর তাসিন প্রথম না হলেও প্রথম দিকেই থাকত। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-শিক্ষামূলক সব কর্মকাণ্ডে ও অংশ নিত। ঘরভর্তি ওর পুরস্কার। শতাধিক মেডেল, ট্রফি ও সনদ রয়েছে।’
তাসিনের বড় ভাই সামিন নটর ডেম কলেজের ইংরেজি ভার্সন থেকে আসন্ন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবেন। ভাইয়ের পদক ও ট্রফি ভেতরের কক্ষ থেকে প্রতিবেদককে দেখানোর জন্য সামনে নিয়ে এলেন তিনি। একটি বড় পলিথিনের ব্যাগভর্তি শুধু মেডেল আর মেডেল।
তাসিন গত বছর বারিধারা স্কলার্স স্কুল থেকে ইংরেজি ভার্সনে জিপিএ–৫ পেয়ে মাধ্যমিক পাস করে। ভর্তি হয় সেন্ট জোসেফ কলেজের একাদশ শ্রেণিতে। এর আগে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও তাসিন জিপিএ–৫ পেয়ে পাস করে।
আহসান উল্লাহ বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে তাসিনও অংশ নিয়েছিল। মৃত্যুর আগের দিন রাতে দুর্ঘটনার একটি নিউজ পড়তে পড়তে ছেলে বলেছিল, বাবা, আজকাল সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। আর পরদিনই আমার ছেলেই এর শিকার হলো।’
আহসান উল্লাহ বলেন, আবরার যেদিন নিহত হন, সেদিন তিনি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিন তাসিনের ঘটনা বলেছিলাম। উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম এসে আবরারের নামে পদচারী–সেতু করার ঘোষণা দিলেন। তিনি তাঁকে গিয়ে তাঁর ছেলের কথাও বললেন। মেয়র তাঁকে বললেন, ‘এখন কি এটা বলার সময়, আপনি অফিসে আসুন, কথা বলব।’ কিন্তু এরপর অনেক চেষ্টা করেও মেয়রের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি।
আক্ষেপের সুরে তাসিনের বাবা বলেন, ‘সন্তান হারানোর কষ্ট একই। আমার বুকটা থেমে থেমে কেঁপে ওঠে। আবরারের মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে, দায়ী বাসচালক ধরা পড়ল, আবরারের নামে পদচারী–সেতু হচ্ছে, আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত, প্রধানমন্ত্রী আবরারের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করেছেন। এর আগে শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুলের দুই ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশে শিক্ষার্থী বিক্ষোভ হয়েছে। আমার তাসিনের জন্য তো কেউ এসে দাঁড়াল না। সেন্ট জোসেফের শিক্ষার্থী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তো তাসিনের জন্য সড়ক অবরোধ করল না। তাসিনের নামে তো পদচারী–সেতু হলো না।’
আহসান উল্লাহ জানান, ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ (ডিএমপি) ১৬টি জায়গায় চিঠি পাঠিয়েছেন। পুলিশকে দিনে দুই–তিনবার ফোন করেন। এখন পুলিশও তাঁর ফোন ধরতে চান না।
তাসিন নিহত হওয়ার দিন খিলক্ষেত থানায় সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারায় একটি মামলা (নম্বর ২৩) হয়। এ মামলায় পুলিশ বাদী। ঘটনার দিন চালক বাস ঘটনাস্থলে ফেলে পালিয়ে যান। তখন থেকে বাসটি থানায় রয়েছে। ঘটনার ৪৪ দিন হয়ে গেলেও চালককে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
তাসিনের বাবা বলেন, ‘পুলিশের কাছেই শুনেছি, বাসের মালিক বাসটি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিদিন থানায় এসে ধরনা দেন। অথচ পুলিশ এখনো চালকের নামই জানে না। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য!’
খিলক্ষেত থানায় তাসিনের মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে আছেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মোফাখখারুল ইসলাম। তাঁর মুঠোফোনে কল করে পরিচয় দিলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, তিনি মামলাটি দেখছেন। মামলার সবশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি অপেক্ষা করতে বলেন। কিছুক্ষণ পর বলেন, তিনি একটু পরে জানাতে পারবেন। কখন ফোন দেব—জানতে চাইলে বলেন, এক ঘণ্টা পর। এক ঘণ্টা পর তাঁকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। একপর্যায়ে ফোনটি বন্ধ করে দেন।
কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. ওবায়দুল হকের সঙ্গে তাসিনদের পরিবারের আত্মীয়তা রয়েছে। সেই সূত্রে প্রায়ই তাঁর কাছে ধরনা দেন তাসিনের বাবা। কিন্তু তিনি নিজেও যেন অসহায়।
ওবায়দুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি কূটনৈতিক বিভাগে আছি। অপরাধ বিভাগের ওপর হাত নেই। চালককে গ্রেপ্তারের তাগিদ দিয়ে প্রায়ই থানায় ফোন দিই। কিন্তু তাঁরা জানান যে চেষ্টা করছেন।’
আহসান উল্লাহ বলেন, ছেলে ‘হত্যার’ বিচার চেয়ে ৩ মার্চ একটি মানববন্ধন করেছেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার ইলিয়াস কাঞ্চন সেই মানববন্ধনে এসেছিলেন। অলিপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ইশফাক আহমেদ পাশে দাঁড়িয়েছেন। অল্প কিছু ছেলেমেয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করেছে।
ইশফাক আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, মানববন্ধনটি শান্তিপূর্ণ ছিল, তাই হয়তো তাসিনের জন্য সুবিচার নিয়ে কেউ আসেননি। হয়তো সড়ক অবরোধ করলে তাসিনও কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ত।
আহসান উল্লাহ বলেন, ‘সময়মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে আমার ছেলেকে হয়তো মরতে হতো না। যে স্থানে আমার ছেলেকে বাসচাপা দিয়েছে, সেখানে আগে একটি পদচারী–সেতু ছিল। রাস্তা পারাপারের বিকল্প ব্যবস্থা না করে সেই পদচারী–সেতুটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন কিছুটা তফাতে নতুন একটি পদচারী–সেতু করা হচ্ছে। এটা আগে করা হলে আমার ছেলেকে মরতে হতো না।’ তিনি ছেলের জন্য সুবিচারের পাশাপাশি নির্মাণাধীন পদচারী–সেতুটির নাম তাসিনের নামে করার দাবি জানান।
দুই কক্ষের বাসাটি থেকে বেরোনোর সময় তাসিনের কক্ষটি দেখার ইচ্ছা হলো। দুই ভাইয়ের জন্য একটি বিছানা। পাশাপাশি দুটো পড়ার টেবিল। দেয়াল ঘেঁষে থাকা টেবিলটা সামিনের। সেখানে এখনো থরে থরে গুছিয়ে রয়েছে বইগুলো। চেয়ারটা শূন্য। তাসিন আর কখনো সেই চেয়ারে বসবে না।