রাইড শেয়ারিং সেবার ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালাকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি কয়েকটি ধারা পুনর্বিবেচনার কথা বলেছেন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একটি গাড়ি কেবল একটি অ্যাপ কোম্পানিতে যুক্ত থাকার নীতি পরিবর্তনের কথাও বলেছেন তাঁরা। নতুন গাড়ি নিবন্ধনের এক বছরের মধ্যে রাইড শেয়ারিং সেবায় যুক্ত হতে না দেওয়ার নীতি নিয়েও আপত্তি তুলেছেন তাঁরা। পাশাপাশি গ্রাহকদের তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা এবং দেশেই তথ্যভান্ডার করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গতকাল মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর সভাকক্ষে ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ২০১৭: প্রয়োগ, সীমাবদ্ধতা ও উত্তরণের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয় উঠে আসে। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও, উবার এবং সহজের সহায়তায় প্রথম আলো এই গোলটেবিলের আয়োজন করে।
বৈঠকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান, উবার, পাঠাও এবং সহজ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তা ও শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা, মোটরসাইকেল প্রস্তুত ও বিপণন কোম্পানির প্রতিনিধি, রাইড শেয়ারিংয়ের যাত্রী, চালক, গাড়ি মালিক, স্টার্টআপ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রতিনিধিরা অংশ নেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
আলোচনার শুরুতেই পাঠাও–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হুসেইন মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, বর্তমান রাইড শেয়ারিং নীতিমালায় পাঁচটি সমস্যা আছে। নীতিমালার ক অনুচ্ছেদের ৯ নম্বর ধারা—এক গাড়ি এক অ্যাপ নীতি থেকে বেরিয়ে আসার সুপারিশ করেন তিনি। এই নীতি অনুযায়ী একটি গাড়ি কেবল একটি অ্যাপ কোম্পানির সঙ্গেই যুক্ত থাকার কথা।
একই অনুচ্ছেদের ১০ নম্বর ধারায় বলা আছে, গাড়ি নিবন্ধনের এক বছরের মধ্যে কেউ রাইড শেয়ারিং সেবায় যুক্ত হতে পারবে না। এ বিষয়ে ইলিয়াস বলেন, নতুন গাড়িকেও এই সেবায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সর্বোচ্চ সেবাটি দিতে হলে নতুন গাড়ির বিকল্প নেই। এ ছাড়া রাইড শেয়ারিং কোম্পানিতে গাড়ি যুক্ত হওয়ার সংখ্যা বেঁধে দেওয়া নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাইড শেয়ারিংয়ের চালকেরা আসলে খণ্ডকালীন সেবা দিয়ে থাকেন।
এই খাতে মূল্য সংযোজন কর আরোপ ও কেবল ঢাকায় নিবন্ধিত যানগুলোকেই রাইড শেয়ারিংয়ের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টিও পুনর্বিবেচনার জন্য বলেছেন ইলিয়াস।
উবারের বাংলাদেশের প্রধান (লিড) জুলকার কাজী ইসলাম বলেন, রাইড শেয়ারিং সেবাকে যানজট বৃদ্ধির জন্য দায়ী করার কোনো কারণ নেই। কেউ দুই মিনিটের মধ্যে গাড়ি পেলে তিনি কেন নিজের গাড়ি কেনার কথা ভাববেন?
সহজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির নীতিমালা প্রণয়নের প্রসঙ্গে সরকারের প্রশংসা করেন। উল্লেখ করেন, অনেক উন্নত দেশ এখনো তা করতে সক্ষম হয়নি। তবে তিনি এক গাড়ি এক অ্যাপ নীতি এবং নতুন গাড়ি যুক্ত হতে না দেওয়ার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এক গাড়ি এক অ্যাপ নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ওই নীতি অনুযায়ী একটি গাড়ি কেবলমাত্র একটি অ্যাপ কোম্পানির সঙ্গেই যুক্ত থাকবে। তাহলে বাজারের বড় কোম্পানিগুলো একচেটিয়া সুবিধা পাবে। সব থেকে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে চালকদের উপার্জনে।
মালিহা কাদির বলেন, উন্নত দেশগুলোতে পাবলিক পরিবহনের অভাব নেই। তার পরেও সেখানে রাইড শেয়ারিং আছে। তারা ভালো করছে। এ দেশে যদি পাবলিক যানবাহনের বিকল্প বাড়ে, তবুও রাইড শেয়ারিং ব্যবহার হতে পারে, যদি জনগণের প্রয়োজন থাকে। মূলকথা—মার্কেট বা কাস্টমারের চাহিদা থেকেই রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরযানের পরিমাণ নির্ধারিত হওয়া উচিত।
রাইড শেয়ারিং কোম্পানির নিবন্ধনের সমস্যা নিয়েও কথা তোলেন মালিহা কাদির। তিনি বলেন, নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আসলে কী কী উপাত্ত দরকার, সে বিষয়ে অস্পষ্টতা আছে। তাই নিবন্ধনপ্রক্রিয়া এখনো ঝুলে আছে।
এসব শুনে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, এ সেবার বিষয়ে সরকারের যে সদিচ্ছার অভাব নেই, তার প্রমাণ এই নীতিমালা। তবে যেখানে ফসল হয়, সেখানে একটু ঘাসও হয়। তিনি বলেন, নীতিমালার অনেক বিষয় আছে খুবই সংবেদনশীল। আর অনেক বিষয় আছে যেগুলোর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই। প্রযুক্তি আছে, সমাধানও আছে। এই খাতে যুক্তদের কাছ থেকে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, সেগুলো নিয়ে তিনি বিআরটিএ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কথা বলবেন বলে জানান।
রানার অটোমোবাইলসের সিএফও নজরুল ইসলাম বলেন, ২০১৭ সালে দেশে সাড়ে চার লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে; যা আগের বছরের দ্বিগুণ। ইয়ামাহা মোটরসাইকেলের এদেশীয় পরিবেশক এসিআই মোটরসের বিজনেস ম্যানেজার রবিউল হক বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও মোটরসাইকেলের দাম কমার কারণে বিক্রি বেড়েছে।
যাত্রী কানিজ ফাতেমা বলেন, তিনি এখন এই সেবায় নিরাপদ বোধ করেন। তবে চালক ও যাত্রীরা কোন কোম্পানির অ্যাপ নেবেন, তা তাঁদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। আরেক যাত্রী জাভেদ ইকবাল বলেন, তিনি ট্রাফিকের অবস্থা ও নিরাপত্তা দেখেই এই সেবাগুলো বেছে নিয়েছেন।
যে সমস্যাগুলো আলোচিত হয়েছে, সেগুলোকে যৌক্তিক আখ্যা দিয়ে আইনজীবী কাজী এরশাদুল আলম চালকদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, গাড়ি ডাকলে অনেক চালক গুগল ম্যাপ দেখে অবস্থান চিহ্নিত করতে পারেন না।
ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক স্ট্র্যাটেজি, কমিউনিকেশন ও এমপাওয়ারমেন্ট আসিফ সালেহ বলেন, গত ডিসেম্বরে ৬৪ জেলায় ব্র্যাকের জরিপে দেখা গেছে, মানুষের প্রথম সমস্যা বেকারত্ব, দ্বিতীয়ত যোগাযোগ। এ অবস্থায় রাইড শেয়ারিং সেবা তরুণদের কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। নারীরাও এতে নিরাপদ বোধ করছেন। তিনিও নীতিমালার আলোচিত কয়েকটি ধারা সংশোধনের ওপর জোর দেন।
গাড়ির মালিক ও চালক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, এখন অনেক শিক্ষার্থী বা চাকরিজীবীও কাজের পাশাপাশি গাড়ি চালিয়ে বাড়তি আয় করছেন। তিনি গাড়িচালকদের আয়কর দাখিলের বাধ্যবাধকতা পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব দেন।
নীতিমালার বিষয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) লোকমান হোসেন মোল্লা বলেন, দ্রুততম সময়ে কোনো বেসলাইন সার্ভে ছাড়াই বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংযুক্ত করে এই নীতিমালা বিআরটিএ করেছে। সে কারণে কিছু সমস্যা থাকা স্বাভাবিক। এখন পর্যন্ত তাঁরা ১৬টি রাইড শেয়ারিং কোম্পানির নিবন্ধনের আবেদন পেয়েছেন। তবে কিছু সমস্যার কারণে কাউকেই এখন পর্যন্ত নিবন্ধন দেওয়া যায়নি।
কিছু বিষয়ের প্রেক্ষাপট জানিয়ে লোকমান হোসেন বলেন, শুরুতে এক গাড়ি এক অ্যাপ নীতি হয়েছিল ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে। মানুষ যাতে রাইড শেয়ারিংয়ে দেওয়ার জন্য গাড়ি কিনতে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে, সে জন্য এক বছরের পুরোনো গাড়ি এই সেবায় যুক্ত না করার নীতিটি করা হয়েছিল। এসবই সময়ের চাহিদায় পরিবর্তন সম্ভব।
স্টার্টআপ বাংলাদেশের টিম লিডার নাঈম আশরাফী বলেন, রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো এখন চাইলে তাদের তথ্যভান্ডার বাংলাদেশেই রাখতে পারে। এখন দেশেও সে ব্যবস্থা আছে।
পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, এই আইন সংশোধনের সময় যেন পুলিশের প্রতিনিধি রাখা হয়। তিনি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো যাত্রীদের তথ্যের নিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত করে সে বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, তথ্য চুরি হলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সবশেষে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাইড শেয়ারিংয়ের বিষয়ে সরকার উদ্যোগী হয়ে একটি নীতিমালা করেছে। তবে এখন কয়েক ধাপে (ফেইজড অ্যাপ্রোচ) বাস্তবায়নের চিন্তা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তথ্যের ব্যবস্থাপনা একটি জটিল ইস্যু। তিনিও দুটি ধারার সংশোধন দাবি করেন।