প্রতিশ্রুতির কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি

নিয়ম অমান্য করে সড়কের মধ্যে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হচ্ছে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
নিয়ম অমান্য করে সড়কের মধ্যে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হচ্ছে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
>

• সাত মাস আগে পাঁচটি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়
• প্রতিশ্রুতির একটিরও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি
• সড়কের পরিস্থিতি আগের মতোই রয়ে গেছে

নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত বছরের আগস্টে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় বেপরোয়া বাস চালানো বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে পাঁচটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার ও পরিবহন মালিক সমিতি। এরপর সাত মাস পেরোলেও এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ নানা নামে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে, কিন্তু সড়কের পরিস্থিতি আগের মতোই রয়ে গেছে।

বেপরোয়া বাস চলাচল বন্ধে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ। চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ রাখা। চালক ও সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর এবং মোবাইল নম্বর বাসের ভেতরে দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন। চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো বন্ধ এবং বাসের চালকদের সিটবেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক সামদানী খোন্দকার স্বীকার করেন, প্রতিশ্রুতিগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেননি তাঁরা। তবে প্রতি মাসে সমিতির সভায় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে মালিকদের অনুরোধ করা হয়।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুর ১, কল্যাণপুর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, কলাবাগান ও শাহবাগ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাসচালকেরা যত্রতত্র যাত্রী ওঠাচ্ছেন-নামাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে চলন্ত অবস্থায় বাস থেকে যাত্রীদের নামতে বাধ্য করছেন। বাসের পাদানিতেও যাত্রীদের ঝুলতে দেখা গেছে। অথচ বাস থামার জায়গা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু নির্ধারিত জায়গায় বাস থামছে না।

চলন্ত অবস্থায় বাসের দরজা বন্ধ রাখার নির্দেশনাও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। কোনো কোনো বাসে চলন্ত অবস্থায় দরজা বন্ধ রাখা হলেও বেশির ভাগ বাসেই তা রাখা হচ্ছে না। সাভার থেকে নিউমার্কেট হয়ে গুলিস্তান পথে চলাচল করা ঠিকানা পরিবহনের কর্মী (চালকের সহকারী) সেকেন্দার আলী বলেন, ‘সারাক্ষণই লোক ওঠা-নামা করে একটু পরপর গেট লাগাতে-খুলতে সমস্যা। সার্জেন্ট সামনে থাকলে গেট লাগাই।’

রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে গতকাল ১০টি বাসে উঠে দেখা যায়, কোনো বাসেই চালকের ছবিসহ লাইসেন্স, মোবাইল নম্বর দৃশ্যমান জায়গায় প্রদর্শন করা হচ্ছে না। মোহাম্মদপুরের বছিলা থেকে উত্তরার আবদুল্লাহপুর পথে চলাচলকারী প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসের চালক বলেন, ‘লাইসেন্স ঝুলাইতে হবে এমন কিছু তো শুনি নাই।’

বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধে গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি না চালানোর ঘোষণা দেয় ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি। সমিতি ঘোষণা করে, কোনো মালিক চালকের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি চালালে তাঁর সদস্যপদ বাতিল করা হবে। বাস্তবে রাজধানীতে এখন বাস চলছে ট্রিপ (যাত্রার শুরু থেকে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত) ভিত্তিতে, যা চুক্তিভিত্তিকেরই আরেক রূপ। দৈনিক বেতনে বাস চালানোর ঘোষণারও বাস্তবায়ন নেই।

মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে কেরানীগঞ্জের কদমতলী পর্যন্ত চলাচল করা দিশারী পরিবহনের চালক মো. রেজাউল বলেন, ‘এক ট্রিপ কম দিলেই আড়াই শ টাকা লস হয়। বেশি ট্রিপ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।’

গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গঠিত হয় একাধিক কমিটি। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ওই আন্দোলনের পর গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গণপরিবহনে সিটবেল্ট সংযোজন করা এবং চালকদের বাধ্যতামূলকভাবে সিটবেল্ট ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় গঠিত কমিটি। এই নির্দেশনার কথা এখনো জানেন না অনেক বাসচালক।

গত বছরের ৫ থেকে ১৪ আগস্ট বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ, ৫ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ট্রাফিক সচেতনতা মাস, ২৪ থেকে ৩১ অক্টোবর ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ পালন করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পালন করে ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ। সর্বশেষ ১৭ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ চলবে ২৩ মার্চ পর্যন্ত।

এবারের শৃঙ্খলা সপ্তাহের প্রথম দুই দিনেই ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেছে ১৪ হাজার ৬৯৪টি। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৭০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।

সড়কের নৈরাজ্য বন্ধে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বলে মনে করেন বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, পরিবহন খাতে মালিক এবং শ্রমিক সমিতি যা চাচ্ছে তাই হচ্ছে। এসব সমিতির বিপক্ষে গিয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার মতো সক্ষমতা এবং জনবল কোনোটিই সরকারি সংস্থাগুলোর নেই।