ফাগুনেরও মোহনায়...
হিমেল হাওয়ায় ফাগুনের গান, বসন্তের ঘ্রাণ। নবীন ও তারুণ্যের বারতা নিয়ে এসেছে বসন্ত। আজ পয়লা ফাল্গুন। পলাশ-শিমুলের লাল ফুলে নবজীবনের দ্যোতনা। কবি আর ভাবালু তরুণের মন উড়ু উড়ু। কিশোরী-তরুণী সাজবে বাসন্তী রঙে, ফুলের সাজে। কবিতা আজ সাদা কাগজে লেখা হবে না, কবিতা কথা বলবে হৃদয়ের ক্যানভাসে। তরুণ-তরুণীর সাদা মনে উড়বে কল্পনার রঙিন ফানুস, যে ফানুস কল্যাণের বার্তা ছড়িয়ে দেবে। হতাশ আর দুর্বলকে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা জোগাবে। বসন্তের কাছে সব মানুষের এটাই তো প্রত্যাশা।
ফাল্গুন ও চৈত্র—বাংলা মাসের হিসাবে এই দুই মাসই রাজত্ব করে ঋতুরাজ। নিশ্চয়ই কোনো বাংলা রচনার প্রথম লাইনের মতো লাগছে। কৈশোরে ‘ঋতুরাজ বসন্ত’ নামের রচনা পড়তে হয়নি—এমন দুর্ভাগ্য খুব কম জনেরই হয়েছে। সেই হিসাবে বসন্তের সঙ্গে আমাদের সখ্য সেই ছোটবেলা থেকেই, যখন ফাগুনের হাওয়া বলতে আমরা বুঝতাম ভালো খাওয়াদাওয়া। তা বাঙালি পরিবারে উৎসব মানেই তো কমবেশি পেটপূজা। সেটি না হলে কি আর বাঙালি ভাতঘুমে প্রশান্তি আসে!
মহানগরীতে বসন্তের প্রথম দিনে অবশ্য ‘ভাতঘুম’ নির্মল বাতাসের মতোই খুব দুষ্প্রাপ্য। এখানে তাই সারা দিন ধরে নয়, নানা আয়োজনে দিনের নানা নির্দিষ্ট সময়ে পালন করা হয় ফাগুনের প্রথম দিনটি। বিকেলেই ফাগুনের আমেজ বাড়ে, কারণ, অফিস-আদালত কামাই করে তো আর সক্কাল সক্কাল বসন্তবাতাসে মন ভাসিয়ে দেওয়া যায় না। এ বছরও নিশ্চয়ই অফিসের কাজকর্ম সেরে সবাই প্রিয়জন নিয়ে ঘুরতে বের হবেন। পোশাক-আশাক হবে সাতরঙা, সাজসজ্জার অনুষঙ্গে সঙ্গী হবে ফুল। হয়তো ঢাকার ধুলাজর্জর বাতাস তাতে একটু বাগড়া দিতে পারে, কিন্তু আবিরমাখা রঙিন মন পর্যন্ত তা পৌঁছাতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ, কে না জানে, প্রফুল্ল মনে বিষাদের স্থানসংকুলান হয় না।
প্রতিবারই বসন্তের প্রথম দিনে রাজধানীতে মানুষের প্রিয় সমাগমস্থল হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মহানগরীর যান্ত্রিক জীবনে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতলব সব সময়ই থাকে। সুতরাং বসন্তের শুভেচ্ছা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে যদি বইয়ের আলমারি ভরিয়ে ফেলারও সুযোগ থাকে, তবে মন্দ কী! উদ্যান ও পার্কগুলোয় পাওয়া যাবে তরুণদের উচ্ছ্বসিত প্রাণখোলা আড্ডার সুবাস। শহরজুড়ে বসন্তকে আবাহন জানাতে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মাইকে শোনা যাবে কবিগুরুর গান-কবিতা। ব্যতিক্রম হবে না এবারও। মাঝেমধ্যে চোখে পড়বে নাচ, ব্যাকগ্রাউন্ডে হয়তো বাজবে ভারতীয় বাংলা ব্যান্ড ‘ভূমি’র গান, ‘ফাগুনেরও মোহনায়, মনমাতানো মহুয়ায়...’
বসন্তের পরই আসছে বাংলা নতুন বছর। শীতের রিক্ততা কাটিয়ে আজকে শুরু হওয়া বসন্ত আমাদের তরতাজা করে দিক, পৌঁছে দিক নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে, সেখান থেকেই হয়তো হবে নতুন শুরু।
ফাগুনের মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে তাই অকারণে মন ভালো করার দিন আজ। সব তিক্ততা ভুলে ভালোবাসায় চোখ রাঙানোর দিন। কবিগুরুর লেখনীতে বলাই যায়—
‘...তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে,
তোমার ঝাউয়ের দোলে
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান॥’