>• ভারতে বেড়াতে গিয়ে ছিলেন বাদল ফরাজি
• ১৩ জুলাই, ২০০৮ ভারতে ঢুকতেই গ্রেপ্তার
• নির্দোষ ফরাজিকে বাদল সিং মনে করা হয়
• খুনের মামলায় ফরাজিকে অভিযুক্ত করা হয়
• ৭ আগস্ট, ২০১৫ ফরাজির যাবজ্জীবন সাজা
• ৬ জুলাই, ২০১৮ দেশে ফিরে কারাগারে ফরাজি
ছেলের মুক্তির জন্য ২৬ দিন ধরে রোজা রাখছেন বাদল ফরাজির মা শেফালি বেগম। মায়ের আশা, আল্লাহ তাঁর ডাক শুনবেন, ছেলে তাঁর কোলে ফিরে আসবে।
বাদল ফরাজি প্রায় ১১ বছর আগে ভারতে বেড়াতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁকে বাদল সিং ভেবে একটি খুনের মামলায় অভিযুক্ত করে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের চেষ্টার পর গত বছরের জুলাইয়ে ভারত তাঁকে দেশে ফেরত পাঠালেও তিনি মুক্তি পাননি। ভারতের আদালতে দণ্ডিত হওয়ায় তিনি কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজা ভোগ করছেন।
গত সোমবার এই প্রতিবেদক কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কারাগারে গিয়ে বাদল ফরাজির সঙ্গে কথা বলেন। বাদল বলেন, তিনি নির্দোষ বলেই বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় দিল্লির তিহার জেল থেকে তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। তাঁকে জানানো হয়েছিল, যত দ্রুত সম্ভব মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু দেশে ফেরার সাত মাস হলেও মুক্তির কোনো লক্ষণ দেখছেন না। দাগি আসামিদের সঙ্গেই দিন পার করছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাদলের মুক্তির বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব। কীভাবে তাঁকে বের করা যায়, একটা উপায় বের করতে হবে।’
বাদল ফরাজি প্রায় ১১ বছর আগে শখের বশে তাজমহল দেখতে পর্যটক ভিসায় ভারতে যাচ্ছিলেন। বেনাপোল সীমান্ত পার হতেই বিএসএফ তাঁকে ‘বাদল সিং’ হিসেবে গ্রেপ্তার করে। বাদল সিং দিল্লির অমর কলোনির এক বৃদ্ধা খুনের মামলার আসামি। ওই সময় তিনি ইংরেজি বা হিন্দি বলতে না পারায় বিএসএফকে সঠিক বিষয়টি বোঝাতে পারেননি। ফলে তাঁকে কারাগারে পাঠাতে হয়। কারাগারেই তিনি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন। একপর্যায়ে কারাগারে ইংরেজির শিক্ষকতা শুরু করেন। সহবন্দীদের ইংরেজি শেখাতেন। স্নাতকের পর আটটি ডিপ্লোমা কোর্সও করেন। বাগেরহাটের ছেলে বাদল গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে, এখন তাঁর বয়স ২৯।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাক্ষাৎকক্ষের দ্বিতীয় তলায় কথা বলার একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাদল। তিনি অনর্গল ইংরেজি ও মাঝে মাঝে ভাঙা বাংলায় কথা বলছিলেন। হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মাতৃভূমিতে ফেরার ডাক পেয়ে আমি আর অপেক্ষা করতেও চাইলাম না। কিন্তু দেশে আসার সাত মাস হলেও মুক্তি পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না। মা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। মাকে দেখতে পাই না। আগে মন্ত্রণালয় থেকে আমার কাছে অনেকে আসতেন, এখন কেউ আসে না। আমি পত্রিকায় পড়েছি, সরকারের অনেকে বারবার বলছে আমি নির্দোষ। তাহলে কেন তাঁরা আমাকে কারাগারে রেখেছেন!’
বাদলের সঙ্গে কথা শেষে মুঠোফোনে কথা হয় মা শেফালির সঙ্গে। তিনি জানতে চান, তাঁর নিরপরাধ ছেলে কবে মুক্তি পাবে। বেঁচে থাকতে কি তিনি দেখতে পাবেন, নাকি বাদলের বাবার মতো ছেলেকে না দেখেই মরতে হবে?
২০১৫ সালের ৭ আগস্ট বাদল ফরাজিকে দিল্লির সাকেত আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে আপিল করা হলেও নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকে। রায়ের পর থেকে তিহার কারাগারের ৩ নম্বর সেলে জীবন কেটেছে তাঁর। এখানে বন্দীদের কাউন্সেলিং করতে আসা মানবাধিকারকর্মী রাহুল কাপুরের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। সব শুনে তাঁকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেন রাহুল। ‘জাস্টিস ফর বাদল’ শীর্ষক একটি আবেদনে স্বাক্ষর অভিযানও শুরু করেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাদলের দণ্ডের বিরুদ্ধে জোর আওয়াজ তোলেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ ভারতের বিভিন্ন পত্রিকা এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। রাহুল বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করলে হাইকমিশন সরকারের কাছে চিঠি পাঠায়। এরপরই বাদলকে ছাড়াতে দুই দেশের মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সভার প্রস্তাবে বাদলকে ‘নির্দোষ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
একটা নির্দোষ ছেলেকে কেন আটকে রাখা হয়েছে, এ প্রশ্নের জবাবে কারাধ্যক্ষ মাহবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের আদালতের রায়ে খুনের দায়ে তাঁর সাজা হয়েছে। এখন দেশে ফিরলেও তাঁকে বাকি সাজা খাটতে হবে। বাকি সাজা বলতে আর কত দিন, জানতে চাইলে উপকারাধ্যক্ষ আমিরুল ইসলাম বলেন, ভারতের প্যানাল কোড অনুযায়ী, বাদলের সাজা ১৪ বছর আর বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ৩০ বছর। এখন কোন আইনে তাঁর সাজা কার্যকর হবে, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। তবে তিনি যে নির্দোষ, সে বিষয়টি হয়তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি আইনগতভাবে অতি দ্রুত সমাধান করা সরকারি কর্মকর্তাদের অবশ্যকর্তব্য। এভাবে গড়িমসি করে মাসের পর মাস নির্দোষ ব্যক্তিকে আটকে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাঁকে তিন দিনের মধ্যে মুক্তি দেওয়া উচিত। পাশাপাশি পুনর্বাসনের জন্য যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।