অতিধনীর বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বে প্রথম। এখন দেখা যাচ্ছে, ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে, বিশ্বে তৃতীয়। দুটি তথ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের। সংস্থাটি বলছে, আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে।
১০ লাখ থেকে ৩ কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদের মালিককে (সাড়ে ৮ কোটি থেকে ২৫০ কোটি টাকা) এ তালিকায় রেখেছে ওয়েলথ-এক্স। প্রতিষ্ঠানটি তাদের উচ্চ সম্পদশালী বা হাই নেট ওর্থ (এইচএনডব্লিউ) বলে অভিহিত করেছে। গত বুধবার ‘গ্লোবাল এইচএনডব্লিউ অ্যানালাইসিস: দ্য হাই নেট ওর্থ হ্যান্ডবুক’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। আর অতিধনী বৃদ্ধির প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে।
নতুন প্রতিবেদনে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধনী বৃদ্ধির হারে শীর্ষে থাকবে, এমন ১০টি দেশের নাম উল্লেখ করা হয়। এ তালিকায় শীর্ষে নাইজেরিয়া। এর পরের অবস্থানে মিসর, যেখানে ধনী বাড়বে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে। বাংলাদেশের পরে আছে যথাক্রমে ভিয়েতনাম, পোল্যান্ড, চীন, কেনিয়া, ভারত, ফিলিপাইন ও ইউক্রেন। জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ হলেও নাইজেরিয়া দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত।
২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে এ হিসাব করেছে ওয়েলথ-এক্স। সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে বলা ছিল, ৩ কোটি ডলার বা আড়াই শ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। ওয়েলথ-এক্সের হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ হারে। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ মোট ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি।
তবে ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদনে দেশে ধনী ও অতিধনীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধির চিত্র উঠে এলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে দরিদ্র মানুষের আয়ে বড় ধরনের বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার বিপরীত চিত্রও রয়েছে। আবার অনেকে মনে করছেন, এই ধনীদের বড় অংশের উত্থান ঘটছে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি কাজ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে।
বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬–এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়। বিপরীতে একই সময় সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৭৩৩ টাকায়, যা ২০১০ সালে ১ হাজার ৭৯১ টাকা ছিল।
জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে একটি টেকসই অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে, এটা সত্য। কিন্তু এটার আলোচনা বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগকে ঢেকে দিচ্ছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, এখন গবেষণা হওয়া দরকার, এই ধনীদের উত্থান কি অর্থনীতিতে অবদান রাখার মাধ্যমে হচ্ছে, নাকি অনৈতিক উপায়ে হচ্ছে। কারণ, ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়মের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ধনী হওয়ার ধারণাটিই সামনে চলে আসে।
আওয়ামী লীগ সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি দমনের দিকে জোর দিচ্ছে। হোসেন জিল্লুর রহমানও মনে করেন, সরকারের এই মেয়াদে উন্নয়ন কৌশল পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
অবশ্য অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে দেশে বৈষম্য বেড়ে যায়। অর্থনীতি একটি টেকসই অবস্থানে যাওয়ার পর এই বৈষম্য কমে যায়। পাশাপাশি স্বজনতোষী পুঁজিবাদ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ চিত্র। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, উন্নয়নের প্রথম দিকে বৈষম্য বাড়তেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। সে ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া।
দেশে আয় বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সরকারও খানিকটা উদ্বিগ্ন বলে উল্লেখ করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘এটা ভালো দিক যে সরকার এটি অনুধাবন করেন। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আমরা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করেছি, যেখানে বৈষম্য কমাতে ব্যাপক জোর দেওয়া হবে।’
শামসুল আলম আরও বলেন, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বিশ্বের মধ্যে বেশি। এই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কারণ সম্পদ তৈরি হচ্ছে। এ সময়ে কোটিপতির সংখ্যা বাড়বেই।
>অতিধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারেও প্রথম হয়েছিল বাংলাদেশ। এর বিপরীতে অবশ্য দেশে ধনী-গরিবের আয়ের বৈষম্যও বাড়ছে।
উন্নয়নের শুরুর দিকে বৈষম্য বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী কি না, তা নিয়ে অবশ্য অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। যেমন, গত ১৫ ডিসেম্বর বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসি ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) আয়োজিত এক নাগরিক সংলাপে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, উন্নয়ন শুরুর দিকে বৈষম্য বাড়তেই হবে, এটা অবশ্যম্ভাবী নয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। তাঁর মতে, ‘দুর্নীতি ও অন্যায়–অনিয়মের বিরুদ্ধে যদি আমরা কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ তৈরি করতে না পারি, এটা যদি ক্রমাগত বিস্তৃতি লাভ করে, তাহলে এর আর্থিক বোঝা ভবিষ্যতে অর্থনীতি নিতে পারবে না।’
সংখ্যায় শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র
ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বে ধনীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখে, যা আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। এশিয়ায় গড় প্রবৃদ্ধি আরও কম, মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। যদিও আলোচ্য সময়ে চলতি মূল্যে এশিয়ার জিডিপি ৮ শতাংশ বেড়েছে। এশিয়ায় ১০ থেকে ৩০ লাখ ডলারের মালিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার।
ধনীর সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষ পাঁচে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (৮৬ লাখ ৭৭ হাজার), চীন (১৮ লাখ ৮০ হাজার), জাপান (১৬ লাখ ১৯ হাজার), জার্মানি (১০ লাখ ২৩ হাজার) ও যুক্তরাজ্য ৮ লাখ ৯৪ হাজার। এরপর রয়েছে ফ্রান্স, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ইতালি।
গবেষণা যেভাবে
ওয়েলথ–এক্স মার্কিন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি ইনসাইট ভেঞ্চার পার্টনারসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি, সম্পদশালীদের সংখ্যা বের করতে তারা সম্পদ ও বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ বা ওয়েলথ অ্যান্ড ইনভেস্টেবল অ্যাসেটস মডেল নামের একটি কৌশল ব্যবহার করেছে। সংস্থাটি বলছে, তাদের কাছে ৫ লাখ ৪০ হাজার উচ্চধনীর তথ্য রয়েছে। সেটা তারা প্রতিবেদনে ব্যবহার করেছে।