বহুদলীয় ভোট, একদলীয় প্রচার

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সামনে প্যান্ডেল খাটিয়ে অবস্থান ধর্মঘটে লতিফ সিদ্দিকী। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সামনে প্যান্ডেল খাটিয়ে অবস্থান ধর্মঘটে লতিফ সিদ্দিকী। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
>

• দীর্ঘদিনের মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী এবার স্বতন্ত্র।
• অনশনের ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দেয়।
• লিয়াকত নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে রাতারাতি ধানের শীষ পেয়ে যান।

জেলা শহর টাঙ্গাইল থেকে কালিহাতীর দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। সকাল সকাল বাইকে করে আমরা রওনা দিই কালিহাতীর উদ্দেশে। পৌষের মাঠে ধান কাটা শেষ। রাস্তার দুই পাশ আলো করে ফুটে আছে রাশি রাশি সরিষা ফুল।

টাঙ্গাইলের আটটি আসনের মধ্যে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) ভোটারদের কাছে ‘বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ।’ অতীতে এখান থেকে নির্বাচিত শাজাহান সিরাজ ও লতিফ সিদ্দিকী দীর্ঘদিন মন্ত্রী ছিলেন। এবার শাজাহান সিরাজ অসুস্থতার কারণে দৃশ্যপটের বাইরে। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর প্রতীক ট্রাক। নৌকা প্রতীকে লড়ছেন বর্তমান সাংসদ হাসান ইমাম খান ওরফে সোহেল হাজারী এবং ধানের শীষে লিয়াকত আলী। লিয়াকত প্রথমে নৌকার মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে রাতারাতি দল ত্যাগ করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগে যোগ দিয়ে ধানের শীষ পেয়ে যান।

লতিফ সিদ্দিকী স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন ছিল তাঁর প্রতি। তাঁর অনুসারীরা এত দিন বলার চেষ্টা করেছেন যে ‘নেতার’ প্রতি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সমর্থন আছে এবং বিজয়ী হলে তিনি আবার মন্ত্রী হবেন। শুরুতে তাঁর মিছিল ও জনসংযোগে লোকসমাগমও বেশি ছিল।

কিন্তু একটি অনশনের ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দেয়। ১৬ ডিসেম্বর লতিফ সিদ্দিকী গোহালিয়াবাড়ি এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় গেলে তাঁর গাড়িবহরে হামলা হয়। এর প্রতিবাদে তিনি ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক তথা রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসের সামনে গিয়ে অনশন শুরু করেন। তাঁর তিন দফা দাবির মধ্যে ছিল কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার, হামলাকারীদের গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকবে এই মর্মে সরকারদলীয় প্রার্থীর কাছ থেকে মুচলেকা আদায়। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে প্রথমে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল ও পরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। সর্বশেষ খবর তিনি হাসপাতাল থেকে ঢাকায় নিজের বাসায় গেছেন এবং দু–এক দিনের মধ্যে নির্বাচনী মাঠে ফিরে আসবেন।

লতিফ সিদ্দিকীর অনুসারীরা ভেবেছিলেন, অনশন করে তিনি সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করতে পারলে ভোটের মাঠে সুবিধা পাবেন। কিন্তু সরকারের অনড় মনোভাবে তাঁর কর্মী–সমর্থকদের অনেকেই নৌকা প্রার্থীর সোহেল হাজারীর সঙ্গে ভিড়ে গেছেন।

পাইকপাড়া সিংহাটিয়া বাজারের এক চায়ের দোকানে ভিড় দেখে থামলাম। সড়কের ওপর সারি সারি নৌকার পোস্টার ঝুলছে। দুই পাশে নৌকার ব্যানার–ফেস্টুন। কিন্তু অন্য কোনো প্রার্থীর পোস্টার কদাচিৎ চোখে পড়ে। পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভোটের পরিবেশ কেমন? বললেন, ভালোই তো, নৌকা ছাড়া আর কারও পক্ষে প্রচার নেই। সব শান্ত। অপর পাশ থেকে আরেকজন বললেন, এখানে ধানের শীষের যিনি প্রার্থী হয়েছেন, দুদিন আগেও তিনি নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। ফলে মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত।

লতিফ সিদ্দিকীর অনশনের কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন নির্লিপ্ত স্বরে বললেন, ‘শুনেছি তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ তাঁকে প্রশ্ন করি লতিফ সিদ্দিকী এত বড় নেতা, মন্ত্রী ছিলেন, তাঁর গাড়িবহরে হামলার ঘটনাকে আপনারা কীভাবে দেখছেন? একজন বলে উঠলেন, ‘আপনারা কি লতিফ সিদ্দিকীর লোক?’ আমরা বললাম, না আমরা কারও লোক নই। ঢাকা থেকে এসেছি নির্বাচন নিয়ে আপনাদের কথা জানতে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণ। তিনি কিছুটা কাছে ডেকে বললেন, কী জানবেন? মনের কথা কেউ বলবে না, বলার মতো পরিবেশ নেই। প্রতিদিন ধরপাকড় হচ্ছে, মামলা হচ্ছে।

টাঙ্গাইল ফেরার পথে কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর মোশারফ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানতে চাই, আসলে লতিফ সিদ্দিকীর ঘটনাটি কী? তিনি বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না তিনি কেন আমার প্রত্যাহার চেয়েছেন। আমরা তো তাঁকে নিরাপদে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলাম। এ ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে। তদন্তে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, আমরা তাদের গ্রেপ্তার করেছি।’

কালিহাতী থেকে ফেরার পথে এলেঙ্গা বাজারে কথা হলো কয়েকজন সংখ্যালঘু নেতার সঙ্গে। ভোটের কথা উঠতেই একজন বললেন, ‘সংখ্যালঘুরা আছে উভয়সংকটে। আওয়ামী লীগ ধরে নেয় আমরা তাদেরই ভোট দেব। এ কারণে তারা আমাদের সুবিধা–অসুবিধার কথা ভাবে না। আর ধানের শীষে ভোট দিলেও বিএনপি বিশ্বাস করে না।’

কালিহাতীর ৩ লাখ ১১ হাজার ভোটারের মধ্যে ৬০ হাজারের মতো সংখ্যালঘু ভোট। জয়–পরাজয় নির্ধারণে তাদের নিশ্চয়ই একটি ভূমিকা থাকবে।

কালিহাতী বাজারে একটি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন কিছু তরুণ। তাঁরা একটি স্মার্টফোনে একটি ভিডিও ক্লিপ দেখে হাসছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘ট্রাকের বিজয় কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না।’ পরিচয় জানতে চাইলে তরুণেরা বললেন, তাঁরা স্থানীয় কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁরা প্রথম ভোটার হয়েছেন। সুযোগ পেলে ভোট দেবেন।
কোনো দলের নির্বাচনী ইশতেহার পড়ে দেখেছেন কি না জানতে চাইলে তাঁরা নেতিবাচক জবাব দেন। আরেকটি দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে বসে কথা বলছিলেন দুজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। তাঁদের জিজ্ঞেস করি, ভোটের অবস্থা কী? একজন বললেন, ‘১৯৬৫ সাল থেকে ভোট দেখে আসছি, এ রকম ভোট জীবনে দেখি নাই।’

এর মধ্যে খবর পেলাম মধুপুর-ধনবাড়ী এলাকায় (টাঙ্গাইল-১) বিএনপির প্রার্থীর গাড়িবহরে হামলা করে উল্টো তাঁদের নেতা–কর্মীদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। নাগরপুর-দেলদুয়ার এলাকায় (টাঙ্গাইল-৬) পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ভয়ে বিএনপির প্রার্থী গৌতম চক্রবর্তীর কর্মীরা মাঠেই নামতে পারছেন না। সখীপুর-বাসাইলে (টাঙ্গাইল-৮) গত তিন–চার দিনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ উপজেলা শাখার সভাপতি আতাউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মীর জুলফিকার শামীমসহ ১০–১২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। কালিহাতীর রতনগঞ্জে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুরের অভিযোগে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তারপরও বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিশ্বাস, ২৪ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী নামলে পরিস্থিতি বদলাবে।