একটি মৃত্যু, বাবার আকুতি
সাদা কাগজের ওপর আনমনে আঁকিবুঁকি করছিলেন আখতারুজ্জামান। সেখানে কোথাও মেয়ের নাম, কোথাও অস্পষ্ট ভাষায় লেখা নানান কথা। চশমার ফাঁক গলে তখন বেরিয়ে পড়ছিল জল। স্বজনেরা সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁকে, কিন্তু বাবার মন মানছে কোথায়? মেয়ের নিথর দেহ যে তখনো পড়ে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। তাই ক্ষীণ হয়ে যাওয়া কণ্ঠে একটু পরপর ঢাকায় অবস্থান করা স্বজনদের মুঠোফোনে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন এই বলে, ‘তোমরা আমার মেয়েটাকে কাটতে (ময়নাতদন্ত) দিয়ো না।’
আখতারুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে বাসের ধাক্কায় নিহত চিকিৎসক আখতার জাহান রুম্পার বাবা। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকাতুর বাবাকে গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর আবাসিক এলাকার এ ব্লকের বাড়িতে পাওয়া গেল এভাবে।
গত ৩ মে নগরের আগ্রাবাদের একটি রেস্তোরাঁয় বেশ জাঁকজমকভাবে চিকিৎসক কাজী মহসিন ফারুকের সঙ্গে বাগদান (এনগেজমেন্ট) হয়েছিল আখতার জাহানের। কথা ছিল নির্বাচনের পর জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বিয়ে হবে। এ উপলক্ষে নতুন করে সাজানো হচ্ছিল তাঁদের ঘর। কিন্তু সেই ঘরে এখন বিষাদের ছায়া।
আখতারুজ্জামান তাঁর বাড়ির নাম দিয়েছেন ‘মুক্তাঙ্গন’। গতকাল সকাল থেকে ছয়তলা এই মুক্তাঙ্গনে ভিড় করেছেন চেনা-অর্ধচেনা অনেক মানুষ। তাঁরা এসেছিলেন শোকাতুর মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিতে। বাড়ির বারান্দায় পাওয়া গেল আখতার জাহানের মামাতো বোনের স্বামী সিরাজুল ইসলামকে। তিনি জানালেন, গত রোববার চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যান আখতার জাহান। এরপর সেখান থেকে সোমবার রাতে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি। ঢাকায় পৌঁছেই মাকে ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু এর একটু পরই দুর্ঘটনায় পড়েন। পরে তাঁর হবু স্বামী কাজী মহসীনকে হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয় দুর্ঘটনার কথা।
মা নূরজাহান বেগম কথা বলার পরিস্থিতিতে নেই। মেয়ের মৃত্যুর খবর শোনার পর তিনি বাড়ির দোতলায় বিছানায় পড়ে আছেন। বাবা আখতারুজ্জামান দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল পরিশোধন স্থাপনা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ময়নাতদন্ত হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। তাতে কী এমন হচ্ছে? তাই আমরা মামলা চাই না। এ দেশে একজনকে জেল খাটিয়ে আমার কী লাভ? সব জায়গায় তো সমস্যা। রাস্তা পারাপারের সময় দুর্ঘটনায় পড়লে বলতাম আমার মেয়ের দোষ ছিল। কিন্তু আমার মেয়ে তো গাড়িতেই ছিল।’
আখতার জাহান চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলীতে ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফথ্যালমোলজি থেকে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন অপটোমেট্রি কোর্স শেষ করে চিকিৎসা পেশায় যোগ দেন। তিনি সিলেটের ওসমানীনগরের বার্ড আই হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। গতকাল সেখান থেকে তিনি রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি চক্ষু হাসপাতালে চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে যাচ্ছিলেন। ভোর পাঁচটার দিকে মহাখালীগামী একটি বাস তাঁকে বহনকারী অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে অটোরিকশাটি উল্টে যায়। লোকজন অটোরিকশার চালককে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়া মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে স্বজনেরা হাসপাতালে আখতার জাহানের লাশ শনাক্ত করেন।
ঘাতক বাসটি পালিয়ে গেছে। ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বাসটি শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে জানালেন তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম।
ওদিকে চট্টগ্রামে বসে বাবা আদরের মেয়েটির মরদেহ না কাটার আকুতি যতই জানান না কেন, আইন নিজস্ব গতিতেই চলে। শেষমেশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বিকেলে আখতার জাহানের লাশ চট্টগ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান স্বজনেরা।
আখতার জাহানের আগ্রহ ছিল গবেষণায়। চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে তাঁর গবেষণা সমাদৃত হয়েছে। এই শ্রমিকদের তিনি দিয়েছিলেন চোখের চিকিৎসাও। বাড়ির আশপাশের দরিদ্র মানুষদেরও বিনা পয়সায় করিয়েছেন চোখের চিকিৎসা। এসব স্মৃতি মনে করে কাঁদছেন বাড়ির আত্মীয়স্বজন আর সেবা পাওয়া মানুষেরা।
গত ৭ অক্টোবর মা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে নিজের একটি ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলেন আখতার জাহান। ছবির ওপরে ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে রবো, আর কোনোখানে যাব নাকো।’
কিন্তু মায়ের কাছে আর থাকা হলো না তাঁর। তাই বলে কি এভাবেই চলে যাবেন?