নির্বাচনের খবরে হিংসে কেন, প্রশ্ন হিরো আলমের
নির্বাচনে বিজয়ী হলে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে ‘পল্লীবন্ধু’ সিনেমা বানাবেন কেবল সংযোগ ব্যবসায়ী থেকে ঢালিউড-বলিউডে অভিনেতা বনে যাওয়া বগুড়ার আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হেরে এলাকাবাসীকে কথা দিয়েছিলেন বলেই সংসদ নির্বাচন করছেন হিরো আলম। আর চা-দোকানি থেকে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে হিরো আলমের এমপি ইলেকশন করার খবরে সবার হিংসে কেন, তা-ও জানতে চান তিনি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পাটির ‘লাঙ্গল’ মার্কায় নির্বাচন করার জন্য বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আবেদনপত্র জমা দেন হিরো আলম। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার খবর ইতিমধ্যেই ফেসবুকে ‘ভাইরাল’ হয়েছে। বগুড়ার স্থানীয় রাজনীতিতেও এখন আলোচনায় বিষয় হিরো আলমের নির্বাচন করার বিষয়টি।
বগুড়া সদরের এরুলিয়া বাজারের একসময়ের সিডি দোকানি হিরো আলম বুধবার প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণ, নির্বাচনী ব্যয়ভার জোগানো ছাড়াও নির্বাচনে জয়ী হতে পারলে এলাকার উন্নয়ন, দেশ ও দেশীয় চলচ্চিত্রের উন্নয়ন নিয়ে তাঁর নানা স্বপ্নের কথা জানান।
হিরো আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুবার ৭১ ও ১৬ ভোটে হেরেছি। তখনই ঘোষণা দিয়েছিলাম, ফের কোনো দিন নির্বাচন করলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করব। আর কোনো ছোট ইলেকশন করব না। সেই সুযোগ এবার কাজে লাগাতে চাই। দলীয় মনোনয়ন হাতে নিয়েই বগুড়ায় ফিরব।’
ইউটিউবে মিউজিক ভিডিও ও চলচ্চিত্রে অভিনয় ছেড়ে হঠাৎ করে নির্বাচনী মাঠে আসার ঘোষণার কারণ জানতে চাইলে হিরো আলম বলেন, ‘হিরো আলম ওয়ার্ল্ড ফেমাস সেলিব্রিটি। ফেসবুকে আমার অনুসরণকারী প্রায় সাড়ে তিন লাখ। আমার নির্বাচন করার ঘোষণায় অনেকেই সমালোচনা করছেন। আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করছেন। কৌতুক করছেন, নানা গুজব ছড়াচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি চা-দোকানি থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে হিরো আলমের এমপি ইলেকশন করার খবরে হিংসে হয় কেন? আমি এ দেশের নাগরিক। আমিও সংসদে গিয়ে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ায় ভূমিকা রাখতে চাই। এটা নিয়ে ব্যঙ্গ-কৌতুক করার আগে একবার ভাবুন, জিরো থেকে হিরো আলম কেমনে হলাম। অনেক সাহস, পরিশ্রম আর স্বপ্নের জোরেই জিরো থেকে হিরো আলম হয়েছি। দেশ-বিদেশের মিডিয়ায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়জনকে নিয়ে এত মাতামাতি হয়েছে? কয়জনকে খোঁজার জন্য গুগলে এত বেশি সার্চ হয়েছে?’
হিরো আলম বলেন, ‘এ দেশে তো অনেকেই জিরো থেকে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি করে মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছে। ইয়াবা ব্যবসার গডফাদাররাও সংসদে বসেছে। রাজাকারেরা মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। হিরো আলম কারও তো কোন ক্ষতি করেনি। সংসদে গেলে দোষ কোথায়? ইউপি নির্বাচনে হেরে এলাকাবাসীকে কথা দিয়েছিলাম ফের ইলেকশন করলে সংসদ নির্বাচনই করব। কাউকে কথা দিলে রাখতে হয়। হিরো আলম কথা দিলে কথা রাখে। সেই জন্যই ইলেকশন করছি।’
সংসদ নির্বাচন করতে গেলে তো প্রচারণায় অনেক টাকা খরচ হবে। নির্বাচনী ব্যয়ভার বহনের কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাবেন কি না? উত্তরে হিরো আলম বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা প্রচারপত্র, পোস্টার-ব্যানার তৈরি করে দেওয়ার কথা বলছেন। অনেকেই নির্বাচনী প্রচারণার ব্যয়ভার বহনের ঘোষণা দিয়েছেন। আমার অর্থ নেই, মানুষের ভালোবাসাই আমার বড় শক্তি। এলাকাবাসীই আমার নির্বাচনী খরচ বহন করবেন। বিনিময়ে নির্বাচিত হতে পারলে সব সময় গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে থাকব। অতীত কখনো ভুলে যাব না। সংসদে যেতে পারলে বগুড়াকে উত্তরবঙ্গের রাজধানী গড়ার ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা রাখব।’
ঢাকার সিনেমায় অভিনয় করেছেন, বলিউড চলচ্চিত্রেও অভিনয় করছেন। সাংসদ হলে অভিনয় ছেড়ে দেবেন কি না? জবাবে হিরো আলম বলেন, ‘নির্বাচনে বিজয়ী হলে অভিনয়-নির্দেশনা সবকিছুই চালিয়ে যাব। সাংসদ নির্বাচিত হলে এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে কাজ করব। জীবনঘনিষ্ঠ সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করব। আমার নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে নিয়ে “পল্লীবন্ধু” নামে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছে আছে। জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের বাড়ি বগুড়ায়। আমার বাড়িও বগুড়ায়। তাঁকে নিয়ে একটা জীবনঘনিষ্ঠ সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ ও পরিচালনা করার স্বপ্ন আছে। অপু বিশ্বাসের নায়ক আমিই হব এমনটা নয়; গল্পের প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে মানানসই কাউকে নায়ক নেব। এ ছাড়া বগুড়ার ঐতিহাসিক বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘরের লোকগাথা নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছে আছে। স্বপ্ন আছে চিত্রায়ণ হবে বগুড়ায়। নায়িকা হিসেবে রাখব বগুড়ার মেয়ে অপু বিশ্বাসকেই।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক বছর ধরে ব্যাপক আলোচিত হিরো আলমের হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসা এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নতুন করে আলোচনায় তিনি। হিরো আলমের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার খবর ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয়ে গেছে। বগুড়ার প্রত্যন্ত এরুলিয়া গ্রামে একসময় সিডি বিক্রি করতেন আশরাফুল আলম। সিডি যখন চলছিল না, তখনই মাথায় আসে কেবল সংযোগ ব্যবসার। কেবল সংযোগের ব্যবসার সুবাদে মিউজিক ভিডিও তৈরি শুরু করেন। ইউটিউবে প্রায় ৫০০ মিউজিক ভিডিও ছাড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন হিরো আলম। ইউটিউবে প্রকাশ করা তাঁর নিজস্ব ভিডিওগুলোও অনেক জনপ্রিয়। ভিডিওগুলোর নির্দেশনাও দেন হিরো আলম। ভিডিওগুলোর মূল চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ইউটিউবে হিরো আলমের এসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তাঁর ভিডিও নিয়ে কৌতুক শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় তাঁর ভিডিও নিয়ে হয় ট্রল। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি।
হিরো আলম বলেন, ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই কর বড় হয়েছেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। সিডির ব্যবসার সুবাদে ২০০৮ সালে নিজেই একটা মিউজিক ভিডিও তৈরি করেন। নায়ক-নির্দেশক তিনি নিজেই। এরপর তা কেবল চ্যানেলে প্রচার করেন। পরিচিতরা প্রশংসা করেন। এরপর সিডি ব্যবসা বাদ দিয়ে মিউজিক ভিডিও বানানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হিরো আলম ইতিমধ্যেই ‘মার ছক্কা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বলিউড পরিচালক প্রভাত কুমারের ‘বিজু দ্য হিরো’ নামে চলচ্চিত্রেও অভিনয় করছেন তিনি।
২০১৬ সালে হিরো আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তোলেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের শিরোনাম হন তিনি। ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হন তিনি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়।
হিরো আলমের সঙ্গে ছবি তুলে ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম ফেসবুকে প্রকাশ করায় বিবিসি হিন্দি, জি নিউজ, এনডিটিভি, ডেইলি ভাস্কর, মিডডের মতো ভারতের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন করে। সেখানে হিরো আলমকে বাংলাদেশের বিনোদনজগতের তারকা বলে উল্লেখ করা হয়।
ফেসবুকে হিরো আলমের রেকর্ড অনুসারীর ভিত্তিতে গুগল তথ্য প্রকাশ করে, বলিউড নায়ক সালমান খানের চেয়েও হিরো আলমকে গুগলে বেশিবার খোঁজা হয়েছে। আলটিমেট ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে ইউএনবির খবরে বলা হয়েছে, গুগলে কাকে সবচেয়ে বেশিবার খোঁজা হয়, তার একটি তালিকা করে ইয়াহু ইন্ডিয়া। জরিপে দেখা গেছে, ‘সুলতান’ ও ‘দাবাং’ তারকা খ্যাত সালমান খানকে পেছনে ফেলেছেন হিরো আলম। সালমানের চেয়েও বেশিবার খোঁজা হয়েছে হিরো আলমকে।
হিরো আলমের বিপক্ষে লড়বেন কারা
হিরো আলম লাঙ্গল প্রতীকে যে আসনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন, কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলা নিয়ে গঠিত সেই বগুড়া-৪ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪১ জন। ১৯৯১ সালে এই আসনে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন দলের প্রয়াত যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক মোল্লা। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৯৪ সালের উপনির্বাচনে প্রয়াত সাংসদের ছেলে জিয়াউল হক মোল্লা দলীয় মনোনয়নে সাংসদ হন। এ ছাড়া তিনি আরও তিন দফা সাংসদ হন। ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর সংস্কারপন্থী নেতাদের পক্ষ নেওয়ায় জিয়াউল হক মোল্লা দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁকে বাদ দিয়ে মোস্তফা আলী মুকুলকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি মহাজোট মনোনীত জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনকে হারিয়ে সাংসদ হন।
২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগে সমঝোতার ভিত্তিতে জাপার নুরুল আমিনকে জেতার সুযোগ করে দিতে মাঠ ছেড়ে দেয়। কিন্তু মহাজোটের অন্যতম শরিক জাসদের রেজাউল করিম তানসেন মনোনয়ন প্রত্যাহার না করলে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে জাপার প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি সাংসদ হন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংস্কারপন্থী জিয়াউল হককে ইতিমধ্যেই দলে ফিরিয়ে এনেছে বিএনপি। জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু গত ২৮ অক্টোবর নির্বাচনী জনসভা থেকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনকে (জাসদ) ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনও এ আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।