সিলেটে কমছে বিবাহবিচ্ছেদ

>
  • যৌতুক চাওয়ার প্রবণতা কমায় ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে
  • যৌথ পরিবারের আধিক্য ও পারিবারিক প্রভাব থাকায় বিবাহবিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে কম

সিলেটে বিবাহবিচ্ছেদ কমছে। সিটি করপোরেশনের এ-সংক্রান্ত নিবন্ধন শাখায় গত সোয়া দুই বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব লোপ পাওয়ার পাশাপাশি যৌতুক চাওয়ার প্রবণতা কমায় এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটের সমাজব্যবস্থায় এখনো যৌথ পরিবারের আধিক্য ও পারিবারিক প্রভাব থাকায় বিবাহবিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে কম বলে মনে করছেন তাঁরা।

সিটি করপোরেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে নগরে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়েছিল ৩৪৪টি। পরের বছর আবেদন পড়ে ৯৪টি। আবেদনের পর উভয় পক্ষকে নোটিশ দিয়ে মেয়র সমঝোতায় বসেছিলেন। সমঝোতা না হওয়ায় ২০১৬ সালে ১০টি এবং ২০১৭ সালে ২৩টি বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়েছিল।

চলতি বছরের ১২ মার্চ পর্যন্ত আবেদন করেছেন ৪১ জন। আবেদনকারীর মধ্যে ৩০ জনই নারী। ১২ জনের ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়েছে। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে মেয়রের মধ্যস্থতায় বৈঠকের কাজ চলছে। সব মিলিয়ে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের ১২ মার্চ পর্যন্ত মোট বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ৪৭৯টি। সে হিসাবে গড়ে দেড় দিনে একজন বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছেন।

বিষয়টি ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক সৈয়দ শিরিন আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটে একসময় প্রচুর তালাকের ঘটনা ঘটত। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বদল হয়েছে, যৌতুক প্রবণতা কমেছে, নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে এবং সর্বোপরি মানুষজন সচেতন হয়েছে।

কয়েকটি তালাকের আবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রবাসে গিয়ে স্ত্রীর খোঁজখবর ও ভরণপোষণ না নেওয়া, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক, মতের অমিল, যৌতুক দাবিসহ বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। পুরুষেরা আবেদনে স্ত্রীর সঙ্গে মতের অমিল, মনোমালিন্যসহ বিভিন্ন কারণের কথা জানিয়েছেন। আবেদনকারী এক নারী বলেন, স্বামী প্রায়ই মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফিরে তাঁকে মারধর করেন। প্রতিবাদ করলে তিনি আরও হিংস্র হয়ে ওঠেন। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে ভালো পথে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়ে তালাকনামা পাঠিয়েছেন।

সিলেটে তুলনামূলকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা কমলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে নারীদের অসহায়ত্বের বিষয় জানা যায়। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সিটি করপোরেশনে আবেদনকারী সাত নারীকে পাওয়া যায়, যাঁদের স্বামীরা প্রবাসী। তাঁদের অভিযোগ, স্বামীরা বিয়ের পর দেশে কিছুদিন থেকে একসময় প্রবাসে চলে যান এবং স্ত্রীদের ভরণপোষণ তো দূরের কথা, খোঁজখবর পর্যন্ত রাখেন না। এ অবস্থায় দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকে তাঁরা তালাকের আবেদন করেছেন। এ রকম একজন নারীর বাসা নগরের আম্বরখানা এলাকায়। প্রথম বিয়ের বিষয়টি গোপন রেখে এক লন্ডনপ্রবাসী তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পর দ্বিতীয় স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে ওই প্রবাসী লন্ডন চলে যান। এরপর থেকে দুজনের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। স্ত্রী ফোনে যোগাযোগ করতে চাইলেও স্বামী কথা বলতে চান না। স্বামীর বাড়িতে গিয়েও স্ত্রীকে ওই পরিবারের সদস্যদের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ অবস্থায় একদিন স্বামী লন্ডন থেকে ফোনে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর উদ্দেশে ‘তিন তালাক’ উচ্চারণ করেন।

সিলেট অঞ্চলে যৌথ পরিবার বেশি থাকার কারণেই বিবাহবিচ্ছেদের মতো ঘটনা কম বলে মনে করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহম্মেদ। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন, এই অঞ্চলের বড় সৌন্দর্য হচ্ছে যৌথ পরিবার। বাবা-মা-ভাই-বোন-ভাবিসহ সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে থাকছেন। এসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কারণে দূরত্ব বেড়ে গেলে অন্য সদস্যরা তা সমাধানে এগিয়ে আসেন। এটা সমাজ ও পরিবারের জন্য ইতিবাচক।

আরও পড়ুন: