>
- নগরের ৫০০ জায়গায় মাদক বেচাকেনা
- সহায়তাকারী হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় পাঁচ থানার ওসিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৫ জনের নাম
- চট্টগ্রাম কারাগারে ৭ হাজার ১৫০ জন পুরুষ ও ৩৩২ জন নারী বন্দীর মধ্যে ৭০ ভাগ মাদক মামলার আসামি
ঘোষণা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে সরকারি বাহিনী ও সংস্থাগুলো। এর আগেও একাধিকবার ঘোষণা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান হয়েছে। তবে পার্থক্যটা হচ্ছে, এবারে একের পর এক কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে, যাতে নিহত ব্যক্তিরা সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী বলে জানানো হচ্ছে।
অভিযানে বড় ধরনের মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার না হলেও গত চার দিনে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ছয়জন। অভিযানে অংশ নেওয়া বাহিনীর একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, মাদক নির্মূলে এখন বন্দুকযুদ্ধকেই ভরসা বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে মানবাধিকারকর্মী ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মতে, শুধু অভিযান দিয়ে মাদক সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ জন্য দরকার মানুষের সচেতনতা। সেটা না হলে মাদক সমস্যা থেকে আমরা কোনো দিনই বের হতে পারব না।’
চলতি মাসে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে পুলিশ, র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গত সোমবার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিনতর ব্যবস্থা নেওয়ার আভাস দেন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মাদক প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থায় যত কাঠামো আছে, তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করবে র্যাব। কারও কাছে মাদক থাকলে তা র্যাবের ক্যাম্পের পাশে ফেলে যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। এর আগে ৩ মে র্যাবের ১৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে র্যাবকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন।
র্যাব সূত্র জানায়, ৪ মে থেকেই র্যাব বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। ১৭ মে পর্যন্ত দেড় হাজার মাদকসেবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে মূল অভিযান শুরু হয়েছে সোমবারের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে। ওই ঘোষণার পর থেকে এখন প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আবদুল আলীম (৫০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। র্যাবের দাবি, নিহত ব্যক্তি একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। এ নিয়ে গত চার দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে যে ছয়জন নিহত হয়েছেন, তাঁদের পাঁচজনকেই মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করছে র্যাব। এর আগে সোমবার রাতে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় দুই ব্যক্তি, বুধবার রাজশাহীতে এক ব্যক্তি ও বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরে আরও দুই ব্যক্তি নিহত হন।
বন্দুকযুদ্ধ কি সমাধান
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মনে করে, দেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা ৬৬ লাখের বেশি। এদের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবীর সংখ্যা ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরা ৪০ কোটির বেশি ইয়াবা বড়ি সেবন করছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড় শ টাকা)। এই টাকার অর্ধেকই চলে যাচ্ছে ইয়াবার উৎসভূমি মিয়ানমারে। হিসাব করে দেখা গেছে, শুধু ইয়াবা বড়ির পেছনে মাদকসেবীদের বছরে যে খরচ, তা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। আর পুলিশের বাজেটের প্রায় অর্ধেক। এই বিপুল প্রক্রিয়া থামানোর কার্যকর উপায় নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়। তবে বিগত বছরগুলোতে দেশে মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা ছড়িয়েছে মহামারির মতো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাদক নির্মূলে যে পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তাদের সদস্যদেরই মাদক চক্রে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের কোনো সদস্য মাদকে জড়ালে চূড়ান্ত শাস্তি বলে প্রকাশ্য আলোচনায় হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক। তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি। এ পরিস্থিতিতে বন্দুকযুদ্ধকেই সমাধান মনে করছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর আগের অভিযানগুলোতে দেখা গেছে, মাদকের আড়তদারেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। প্রভাবশালী এসব মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ আছে। যারা অভিযানের জালে ধরা পড়ছে, তাদের বেশির ভাগই ছিঁচকে বা নিচের স্তরের।
পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সারা দেশে মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের একটি তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। বিভিন্ন বাহিনীর নেওয়া তালিকাগুলো সমন্বয় করে একটি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই তালিকা ধরেই অভিযান শুরু হয়েছে। এটা ধাপে ধাপে চলবে। মাদকসেবী ও খুচরা বিক্রি করছে যারা, এখন তাদের ধরা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের সাজা দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে মাদক ব্যবসায়ী এবং যেসব এলাকা দিয়ে দেশে মাদক প্রবেশ করছে, সেসব এলাকায় কঠোর অভিযান চালানো হবে। একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা হেছে, কঠোর অভিযান বলতে তাঁরা বন্দুকযুদ্ধকেই বোঝাচ্ছেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা মনে করেন, বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসা যারা করে, তারা তো ভয়ংকর লোক। সে ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যদি গোলাগুলিতে কেউ মারা যায়, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে ধরলাম, মেরে দিলাম, এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। কারা ব্যবসা করছে, কারা এদের মদদ দিচ্ছে, এর মূল খুঁজে বের করতে হবে। তাদের আইনের আওতায় এনেই নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজতে হবে।’