বর্ষায় বৃষ্টির গানের সঙ্গে ব্যাঙের ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ’ তান এক সুরে বাঁধা । ব্যাঙ প্রকৃতির প্রাণ, পরিবেশের রক্ষাকবচ। মানববসতির বিস্তৃতি আর নগরায়ণ জলাজঙ্গল সাফ করে দিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ব্যাঙের নিরাপদ আবাস। এ জন্য পথেপ্রান্তরে চিরচেনা ‘ব্যাঙের ডাক’ তুলনামূলকভাবে কম শোনা যায়। সমীক্ষা বলছে, দেশে ১০ প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ৪৯ প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। বিলুপ্ত না হলেও এসব ব্যাঙ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। জলাভূমি কমে গিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, কৃষিজমিতে কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, খাওয়ার জন্য ব্যাঙ শিকার ইত্যাদি কারণে দেশে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ডাঙায় ও পানিতে অবাধে বিচরণ করা এই উভচর প্রাণী প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্যাপক হারে পোকা দমন করতে পারার কারণে ব্যাঙকে ‘পোকা মারার প্রাকৃতিক যন্ত্র’ বলা হয়ে থাকে। একটি এলাকার পরিবেশ কেমন, তা পরিমাপে ব্যাঙ সূচক হিসেবে কাজ করে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের রেড লিস্ট বা লাল তালিকা অনুসারে, বাংলাদেশে ৪৯ প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বিপন্ন ব্যাঙের মধ্যে দুই প্রজাতি মহাবিপন্ন, তিন প্রজাতি বিপন্ন ও পাঁচ প্রজাতি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ২৭ প্রজাতি কিছুটা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। ছয় প্রজাতি বিপন্ন অবস্থায় নেই।
এর পাশাপাশি ছয় প্রজাতির সমীক্ষাসংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। এগুলো ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে, তা জানা যায়নি। এর আগে ২০০০ সালে আইইউসিএন দেশে ২২ প্রজাতির ব্যাঙ থাকার কথা জানায়। ওই সময়ের তালিকা অনুসারে, কোনো প্রজাতির ব্যাঙ মহাবিপন্ন অবস্থায় ছিল না। তখনো তিন প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় ছিল। আর সাত প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় ছিল না। পাশাপাশি আরও সাত প্রজাতির ব্যাঙ সম্পর্কে তথ্য ঘাটতি ছিল।
এ ছাড়া ছোট পরিসরে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকেরা ঢাকা, রংপুর ও দিনাজপুরে ব্যাঙের ওপর সমীক্ষা করেন। সেসব জরিপে রাজধানী ঢাকায় ১১ প্রজাতি এবং রংপুর ও দিনাজপুরে ১৩ প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়ার কথা জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাঙের বিপন্ন অবস্থা ও তথ্যের ঘাটতি থাকা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। দিনে দিনে জলাভূমি কমে যাচ্ছে। লোকজন জলাভূমি ভরাট করে ফেলছে। ফলে কমে যাচ্ছে ব্যাঙের আবাস। অন্যদিকে, চাষাবাদে কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে ব্যাপক হারে ব্যাঙ মরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাঙ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাঙ ফসলের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে প্রাকৃতিকভাবে পোকা দমন করে। ব্যাঙকে ‘পোকা মারার প্রাকৃতিক যন্ত্র’ বলা হয়। একটি ব্যাঙ প্রতিদিন তার দেহের অর্ধেক পরিমাণ পোকা খেতে পারে। ফসলের খেতে প্রচুর পরিমাণে ব্যাঙ রাখা গেলে তারাই পোকা দমনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারত।
নিয়ামুল নাসের বলেন, ব্যাঙ কমতে থাকায় অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য উৎসেও সংকট তৈরি হচ্ছে। কারণ, ব্যাঙও জলজ অনেক প্রাণী, সরীসৃপ ও পাখির খাবার। ব্যাপক হারে ব্যাঙ কমে যাওয়ায় এসব প্রাণীর খাবারও কমে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আরেক অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ৪৯ প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। এর মধ্যে সবুজ ব্যাঙ, কোলা ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ ও সোনা ব্যাঙ বেশি দেখা দেয়। এর বাইরে ছোট ছোট কিছু ব্যাঙ আছে, যেগুলো শুধু বনেই পাওয়া যায়। এই ব্যাঙগুলো প্রকৃতির রঙের সঙ্গে মিশে থাকে। এগুলো গাছের পাতা বা ডালের রঙের সঙ্গে মিশে লুকিয়ে থাকে। এভাবে শিকারিদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে। তিনি বলেন, বিলুপ্ত না হলেও দেশে ব্যাঙের সব প্রজাতি খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, পানিদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন—প্রধানত এই তিন কারণে ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক ফিরোজ জামান। তিনি বলেন, কৃষিজমিতে দানাদার কীটনাশক ছিটানো হয়। এটা ব্যাঙের জন্য খুব ক্ষতিকর। এই কীটনাশকের কারণে পানির ছোট ছোট পোনা মাছ থেকে শুরু করে ব্যাঙাচি মরে যায়।
দিন দিন জমির ব্যবহার বাড়ছে। আর পতিত জলাভূমি, পুকুর কমে যাচ্ছে। এভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া ব্যাঙ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এটা প্রভাব ফেলছে ব্যাঙের প্রজননে। জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস এবং বর্ষার পুরো সময়টা ব্যাঙের প্রজননের আদর্শ সময়। ব্যাঙাচি বেঁচে থাকার জন্য জমে থাকা পানি দরকার। এখন অসময়ে বৃষ্টি হয়। এই সময়ে এভাবে প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। অথচ হচ্ছে। এর ফলে ব্যাঙ প্রজননে উদ্বুদ্ধ হলেও এই সময়ের বৃষ্টিতে পানি জমে থাকে না বলে ব্যাঙাচিগুলো টিকতে পারছে না।
পরিবেশের ভারসাম্য রাখতে ব্যাঙ টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ফিরোজ জামান। তিনি বলেন, ব্যাঙ ফসলের ক্ষতিকর পোকা খায়। বড় সোনাব্যাঙ ও সবুজ ব্যাঙ ২০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এসব ব্যাঙ দেহের অর্ধেক পরিমাণ পোকা প্রতিদিন খেতে পারে।
একটি এলাকার পরিবেশ কেমন সেটা পরিমাপে ব্যাঙ সূচক হিসেবে কাজ করে। কোনো এলাকায় ব্যাঙ বেশি মানে ধরে নেওয়া হয়, সেখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রয়েছে। ব্যাঙ না থাকা এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয় রয়েছে বলে ধরা হয়।
তবে দেশে ব্যাঙ নিয়ে তেমন গবেষণা হয় না বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশে ব্যাঙ নিয়ে কার্যকর কোনো গবেষণা হয়নি বলে স্বীকার করেছেন বন বিভাগের বন্য প্রাণী শাখার বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের মনোযোগ নেই বলেও তিনি স্বীকার করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দেশের পরিবেশ আইন অনুসারে ৪০টি রক্ষিত এলাকা রয়েছে। সেসব এলাকায় কিছুটা জরিপ হয়েছে। বাকি এলাকায় ব্যাঙ নিয়ে সেভাবে জরিপ ও গবেষণা হয়নি। দেশে ব্যাঙের বিভিন্ন প্রজাতি বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। জরিপ হলে ব্যাঙের বিপন্ন অবস্থার কারণগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হতো। তবে দেশে কী পরিমাণ ব্যাঙ রয়েছে, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই বলে তিনি জানান।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যাঙ সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আজ শনিবার পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ব্যাঙ দিবস। এ দিবস পালন উপলক্ষে সেভ দ্য ফ্রগস বাংলাদেশ এবং জুয়োলজিকেল সোসাইটি অব বাংলাদেশ যৌথভাবে আলোচনা সভা, সচেতনতামূলক র্যালি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। আজ সকাল নয়টা থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে আলোচনা সভা হবে।