লাল ইটের তৈরি বলে স্থানীয় মানুষের কাছে এটি ‘লাল গির্জা’। মূল গির্জাটির রং লাল হলেও এর আঙিনায় পরতে পরতে সবুজের সমারোহ। গির্জার দক্ষিণ পাশে শানবাঁধানো বড় পুকুর। পুকুরের টলটলে জলে গির্জার মোহনীয় প্রতিবিম্ব দৃশ্যমান হয়।
এই হলো বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন গির্জা। মূল ফটকের সামনে বড় করে লেখা ‘এপিফানি গির্জা, বাংলাদেশ’। গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এক অপরূপ শৈল্পিক নিদর্শন। বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডের (জীবনানন্দ দাশ সড়ক) পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গির্জাটি। ১১৪ বছরের প্রাচীন এই স্থাপনা বরিশাল নগরীর ঐতিহ্যের স্মারক। লাল গির্জা কেবল ধর্ম প্রচার ও প্রার্থনার কেন্দ্রই নয়, শিক্ষা বিস্তারে ও মানবসেবায় এই গির্জা অবদান রেখে চলেছে। এটি এশিয়ার অন্যতম বড় উপাসনালয় এবং দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তিগুলোর একটি।
গির্জাটি একতলা হলেও উচ্চতা চারতলা ভবনের সমান (প্রায় ৫০ ফুট)। গির্জার প্রাথমিক নকশা করেন সিস্টার এডিথ। পরে তৎকালীন বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ ফাদার স্ট্রং সেই নকশা উন্নত ও চূড়ান্ত করেন। প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক ফ্রেডরিক ডগলাস।
৪০টি খিলানের ওপর গির্জাটি দাঁড়িয়ে আছে। সুদৃশ্য পামগাছে ঘেরা চারদিকের সীমানা। ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি গাঢ় সবুজ আঙিনা, বৃক্ষশোভিত উদ্যান, মাঠ, ফুল ও ঔষধি বাগান। বিশাল ও নান্দনিক প্রার্থনাকক্ষ এ গির্জার প্রধান আকর্ষণ। ৩৫ একর জমির ওপর উঁচু প্রাচীরঘেরা এই গির্জার অভ্যন্তরে ১৩টি ছোট-বড় পুকুর আছে।
মূল গির্জার আদলে পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি টাওয়ার, নাম বেল টাওয়ার। তাতে রয়েছে একটি সুদৃশ্য ঘণ্টা। বিশাল এই ঘণ্টা দিনে সাতবার বেজে ওঠে। ঘণ্টাধ্বনি শুনেই ভক্তরা এখানে প্রার্থনার জন্য সমবেত হন।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯০৩ সালের ২৬ জানুয়ারি এটির উদ্বোধন করা হয়। ওই দিনই ‘এপিফানি গির্জা ভগ্নী সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ছাদ কাঠের তৈরি, আর মেঝেতে সুদৃশ্য মার্বেলের টাইলস। মূল বেদির ওপর স্থাপিত একটি বড় ক্রুশ।
গির্জা সূত্রে জানা যায়, প্রার্থনাকক্ষের চারটি বেদির মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। আর বড় ক্রুশটি আনা হয়েছিল ফিলিস্তিনের বেথলেহেম থেকে। গির্জাটির স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল দেশীয় মাটি দিয়ে তৈরি আস্তনে পোড়া লাল শক্ত ইট দিয়ে। ১১৪ বছর পেরোলেও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণে এটি এখনো ঝকঝকে-তকতকে, সতেজ রয়েছে।
গির্জার ব্যবস্থাপক সুধীন সরকার বললেন, গির্জাটি ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ। এখানে দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০০ শিক্ষার্থী আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকজনের পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কলেজের ২৫ জন ছাত্রী এখানকার ছাত্রীনিবাসে বাস করছে। আর মিশনের চিকিৎসাকেন্দ্রে মা ও শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
লাল গির্জা ও জীবনানন্দ দাশ
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘আকাশে সাতটি তারা’। কথিত আছে, কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রথম প্রেমিকা মনিয়াকে নিয়ে। এই অক্সফোর্ড মিশন গির্জাতেই মনিয়ার দেখা পেয়েছিলেন কবি। মনিয়ার মা ছিলেন এই গির্জারই একজন সেবিকা। ছাত্রাবস্থায় কবি অক্সফোর্ড মিশনের ছাত্রাবাসে দীর্ঘ সময় বাস করেছেন। ফলে এখানকার ফাদার ও মাদারদের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। তা ছাড়া গির্জাটি কবির বসতবাড়ি-লাগোয়া। গির্জার পামগাছের ফাঁক গলানো রোদ্দুর আর বাতাসে পাতার দোল খাওয়ার দৃশ্য কবিকে আলোড়িত করেছিল।