আরেক দফা সংস্কার হচ্ছে বাংলা বর্ষপঞ্জি
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যখন মাতৃভাষার দাবিতে মিছিল নিয়ে ছাত্র-জনতা বেরিয়ে এসেছিল, বাংলা বর্ষপঞ্জির পাতায় দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন। কিন্তু এখন যখন ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়, বর্ষপঞ্জিতে সেটা পড়ে ৯ ফাল্গুন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের দিনটা ছিল পয়লা পৌষ। এখন দিনটি পড়ছে ২ পৌষে। আবার উল্টো ঘটনা ঘটে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন ২৫ বৈশাখ বা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা সাধারণ মানুষ যেটাকে ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে চেনে, সেটার সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির বিশেষ দিনগুলোর এই ব্যত্যয় দূর করতে এবার আরেক দফা সংস্কার করা হচ্ছে প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির তারিখগুলোর সমন্বয় করাই এই সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য। এবার সংস্কার হলে জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির গৌরবদীপ্ত দিনগুলো গ্রেগরিয়ান এবং বাংলা বর্ষপঞ্জিতে অভিন্ন (ফিক্সড) থাকবে। পাশাপাশি বাংলা মাস গণনাসংক্রান্ত কিছু অসামঞ্জস্যও দূর করা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি সংস্কারের কাজ করছে বাংলা একাডেমি। ১৪২৫ সন, অর্থাৎ আরও এক বছর পরের নববর্ষ থেকে নতুন দিনপঞ্জিকা চালু হবে।
বাংলা বর্ষপঞ্জি এর আগেও দুই দফা সংস্কার হয়েছে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমরা যদিও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনযাত্রার প্রায় সব প্রয়োজনেই গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করি, তবু এর সমান্তরালে কৃষিসহ দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান ও ইতিহাসের গৌরবময় অর্জনের দিনগুলোতে বাংলা দিনপঞ্জির তারিখও একইভাবে অনুসরণ করা হয়। এ কারণেই এই দুই দিনপঞ্জিকার সমন্বয় করা জরুরি হয়ে উঠেছে।’
সংস্কারের পটভূমি: বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ প্রথম শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে। প্রখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহাকে প্রধান করে ভারত সরকার প্রথম ভারতবর্ষের দিনপঞ্জিকা সংস্কার কমিটি করে। তিনি ভারতে প্রচলিত প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যাভিত্তিক বর্ষপঞ্জিকার আমূল পরিবর্তন করে আধুনিক গণনার ভিত্তিতে শকাব্দভিত্তিক বর্ষপঞ্জির সংশোধন করে ১৯৫৪ সালে প্রস্তাব পেশ করেন। তাতে বলা হয়, বৈশাখ থেকে ভাদ্র—এই পাঁচ মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র—এই সাত মাস ৩০ দিন হিসেবে গণনা করা হবে। অধিবর্ষে (লিপইয়ার) চৈত্র মাস হবে ৩১ দিনে। সাহা কমিটির সুপারিশ যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভারত সরকার আশির দশকে অধ্যাপক এস পি পান্ডের সভাপতিত্বে আরেকটি পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি করে। পান্ডে কমিটিও সাহা কমিটিকে মূল ধরে ১৪ এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ হিসেবে নির্ধারণ করে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করে।
শহীদুল্লাহ কমিটি: প্রথম থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারে ভূমিকা নেয় বাংলা একাডেমি। বাংলা বর্ষপঞ্জিকার আরও সংস্কারের জন্য ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ নামে একটি কমিটি করে বাংলা একাডেমি। এটি ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’ নামে পরিচিতি পায়। এই কমিটি মেঘনাদ সাহার সুপারিশকে সামনে রেখেই কিছু সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের সুপারিশ পেশ করে। সংস্কারের প্রধান বিষয়গুলো ছিল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনের পরিধি মাপের প্রচলিত রীতি পরিবর্তন করে গ্রেগরিয়ান রীতি অনুসারের রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে দিনের সূচনা (তারিখ পরিবর্তন হবে) হিসেবে গণ্য করা। তাদের সুপারিশেও অধিবর্ষে চৈত্রে ৩১ দিনের কথা বলা হয়। তবে পরে দেখা যায়, অধিবর্ষ গণনার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা ছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি নথিতে বাংলায় নোট লেখার পাশাপাশি বাংলায় স্বাক্ষর ও তারিখ লেখার নিয়ম করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হলে এই নিয়ম আরও জোরদার করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে এই নিয়ম বাধ্যতামূলক করে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে এর ভিত্তিতে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে বাংলা দিনপঞ্জিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অধিবর্ষ গণনার ক্ষেত্রের জটিলতার বিষয়টি দেখা যায়। তখন শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে।
টাস্কফোর্স: বাংলা বর্ষপঞ্জিকাকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক করার জন্য ১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদকে প্রধান করে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, ভাষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। একাডেমির পরিচালক ও পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির সদস্য অপরেশ কুমার ব্যানার্জি প্রথম আলোকে জানান, এই কমিটি মেঘনাদ সাহা ও শহীদুল্লাহ কমিটির মূল সুপারিশের নিরিখে ওই বছর ২৯ আগস্ট তাদের ২০টি সুপারিশ পেশ করে। এর উল্লেখযোগ্য ছিল চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুনকে অধিবর্ষের মাস হিসেবে নির্ধারণ করা। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জিতে যে বছর ফেব্রুয়ারি মাস অধিবর্ষ হবে, সেই বছর বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে হবে ৩১ দিন। এখন পর্যন্ত এই নিময় অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে এখনো জাতীয় দিবসগুলোয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও বাংলা বর্ষপঞ্জি মূলানুগ হচ্ছে না। আর অধিবর্ষ গণনার ক্ষেত্রেও জটিলতা পুরোপুরি নিরসন হয়নি।
তৃতীয় দফায় নতুন কমিটি: বাংলা বর্ষপঞ্জির বিদ্যমান অসামঞ্জস্য দূর করে পুরোপুরি বিজ্ঞানভিত্তিক এবং জাতীয় দিবসগুলোকে মূলানুগ করতে এবার তৃতীয়বার সংস্কার কমিটি করা হয়েছে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে সভাপতি করে ২০১৫ সালে এই কমিটি করা হয়। এতে সদস্য হিসেবে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়, পদার্থবিজ্ঞানী জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক আলী আসগর, একাডেমির পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জি প্রমুখ। এই কমিটি প্রধানত বিশেষ দিনগুলোয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও বাংলা বর্ষপঞ্জিকে মূলানুগ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পরিকল্পনা ছিল সংস্কার শেষে ১৪ এপ্রিল ২০১৭ থেকে (বাংলা ১৪২৪ সন) নতুন বর্ষপঞ্জি চালু করা হবে। কিন্তু কিছু কাজ বাকি থাকায় তা হচ্ছে না। মহাপরিচালক জানান, এই বছর, অর্থাৎ ২০১৭ সালের ভেতরেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। আগামী ১৪২৫ সন থেকে নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জিকার গণনা শুরু করা হবে।