পরিচিত পোশাকে বসে ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। পাজামা-পাঞ্জাবি। পবিত্র সরকার এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁদের মধ্যে মৃদু কথাবার্তাও হচ্ছে। বিপরীত দিকের একটা সোফায় বসে আছেন সিদ্দিকা জামান—আনিসুজ্জামানের সঙ্গে যিনি পার করেছেন জীবনের অনেক বড় পথটি। তাঁর কাছে গিয়ে বসি। শুক্রবার বেলা ১১টার মৃদু আলো তখন ঢুকছে জানালা দিয়ে। আজ শনিবার আনিসুজ্জামান ৮০ বছর পূর্ণ করলেন।
‘এই মানুষটার সঙ্গে থেকে গেলেন এত দিন। কেমন মানুষ তিনি?’
‘অসাধারণ।’ বললেন সিদ্দিকা জামান।
‘এতটা পথ কেমন কেটেছে আপনাদের?’
‘আমার মনে হয় আমাদের জীবনটা খুব সহজ-স্বাভাবিকভাবে চলে গেছে। খুব দ্রুত গেছে, ঝরনার মতো বয়ে গেছে। আমার সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, ও বাড়ি নিয়ে আমাকে কখনো যন্ত্রণা দেয়নি। আমি যেভাবে চালিয়েছি, ও সেটা মেনে নিয়েছে। আমি যেভাবে জানি, ওর কী পছন্দ; বাচ্চাদের সেভাবেই মানুষ করার চেষ্টা করেছি।’
একই প্রশ্ন থাকে আনিসুজ্জামানের কাছে। সাবলীলভাবে সিদ্দিকা জামান সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘বেবী (সিদ্দিকা জামানের ডাকনাম) পারিবারিক সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে আমাকে কাজের সুবিধা করে দিয়েছে। তবে সে পরিমাণ কাজ আমার দ্বারা হয়নি। আমি মূলে যেটা করতে চেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে, আঠারো শতকের আগের বাংলা গদ্য নিয়ে। বইটা লিখলাম, কিন্তু নমুনাগুলো সংকলন আকারে—ওটা আর এখনো করা হলো না। ওটা হওয়া উচিত ছিল।’
আমাদের ইতিহাসের বাঁকগুলোয় আমরা আনিসুজ্জামানকে পাই। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণ-আদালত পর্যন্ত প্রতিটি বাঁকেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিষয়টি মনে করিয়ে দিতেই বললেন, ‘কীভাবে এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকলাম, বলা আসলে কঠিন। তবে আমাদের সময়টাই এমন ছিল, যখন ছাত্র ও যুবকেরা নানা রকম সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আমি তাদের মধ্যে পড়ে গেছি। প্রথমে তো ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দিই। সে সময়কার একমাত্র অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। সেই অসাম্প্রদায়িকতার টানেই ওখানে যাওয়া। তারপর তো ভাষা আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের কথা যদি বলো, ১৯৬০-এর দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আমরা সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকেও করেছি, পথেঘাটে নেমেও করেছি। এরই চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া। খুব পরিকল্পিতভাবে যে গিয়েছিলাম, তা বলতে পারি না। প্রথমে তো পালানো। জীবনরক্ষা। তারপর আগরতলা, কলকাতা। ইতিহাস আমাকে আনুকূল্য করেছে।’
‘আর গণ-আদালত?’
‘ওখানেও আমার ভূমিকাটা বড় নয়। জাহানারা ইমাম বয়সে আমার বড় হলেও উনি আমার ছাত্রী ছিলেন। তিনি যখন বললেন, আপনি আসুন, তখন গেলাম। তারপর কথা হলো, কারা অভিযোগকারী হবে। ঠিক হলো সৈয়দ শামসুল হক, বোরহান (বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর) আর আমি। আমি বললাম, আমি তো দেশে ছিলাম না, তাই গোলাম আযম সম্পর্কে আমার কিছু বলতে হলে বলতে হবে বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যা যা করেছেন। বোরহান বলল বাঙালি সংস্কৃতিবিধ্বংসী কী কাজ করেছে। আর সৈয়দ শামসুল হকের অভিযোগ ছিল সামগ্রিকভাবে বাঙালি নিধন। এই তিনটি অভিযোগ নিয়েই গণ-আদালত।’
‘আপনার ভালো লাগা উপন্যাস, ভালো লাগা সিনেমা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলবেন?’
‘আসলে এত কিছুই ভালোবাসি যে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা মুশকিল। বুদ্ধদেব বসুর একটি প্রেমের কবিতা আছে, যেখানে বলছেন, আমরা কত কিছুই ভালোবাসি, তাহলে প্রেমটা কী? আমারও সে রকম বলতে হয়, অনেক কিছুই ভালোবাসি। আলাদা করে বলা মুশকিল। নিশ্চয়ই একটা সময়, উদাহরণ হিসেবে বলছি, রবীন্দ্রনাথের গোরা পড়েছি। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। রাত জেগে পড়েছি। তেমনি আমার খুব প্রিয় লেখক এরিক মারিয়া রেমার্ক, জার্মান ভাষায় যিনি প্রথম মহাযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন, তাঁর একাধিক বই আমার প্রিয়। ফিল্ম যদি বলো, তাহলে প্রথমেই বলব রোমান হলিডে। সেটা বোধ হয় আমাদের কালের সবার পছন্দের ফিল্ম। তারপর হয়তো ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই। বাংলা ছবির একটা তো সুসময় গেছে, তখনো বোধ হয় আমরা সাবালক হইনি। তবে কিছু দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে, তখনকার যারা শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ছিলেন—ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী স্যান্যাল—তাঁদের দেখেছি। এ রকম নানা কিছুই আছে।’
একটানা বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল আনিসুজ্জামানের। শরীর খুব সুস্থ নয়। চিকিৎসা চলছে। তাঁকে রেহাই দিয়ে আমরা আবার ফিরি সিদ্দিকা জামানের কাছে।
জিজ্ঞেস করি, আনিসুজ্জামানের পছন্দের খাবার কী?
‘সবচেয়ে পছন্দ করে চিংড়ি মাছের মালাইকারি। তারপর তার দ্বিতীয় পছন্দের খাবার হচ্ছে গরুর গোশত, আলু দিয়ে রান্না করা। মাছের মধ্যে ইলিশ মাছ খুব পছন্দ, সরষে ইলিশ বিশেষ করে। ভাজা মাছ পছন্দ করে, তেলের মধ্যে পেঁয়াজ বেরেস্তা দিয়ে।’
‘কোথাও পড়েছিলাম, বাজার করতে তিনি পছন্দ করেন না।’
‘বাজার করা পছন্দ করে না। তবে চট্টগ্রামে থাকতে বাজার করত।’
যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁরা জানেন সিদ্দিকা জামানের সারল্য অতুলনীয়। বিদায়ের সময় তিনি যা বললেন, তাতে সে কথাই মনে হলো আরেকবার, ‘আমি এতটুকু বুঝে নিয়েছিলাম, ও একজন শিক্ষক। আমাকে সেটা মনে রেখেই চলতে হবে। আমাদের সীমিত রোজগার। ছেলেমেয়েদেরও আমি সেভাবে বুঝিয়েছি। আমাদের ছেলেমেয়েরাও কোনো দিন আমাদের কাছে কোনো কিছু চেয়ে বিব্রত করেনি। তারা সব সময় বুঝেশুনে চলেছে। সেদিক দিয়ে ভাবলে, আমরা খুব শান্তিপূর্ণ জীবন কাটিয়েছি।’
আরও অনেক দিন শান্তিতে থাকুন আপনারা। আনিসুজ্জামান, আপনি শতায়ু হোন।