এবার আলোচনায় আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদ

আছাদুজ্জামান মিয়াছবি: সংগৃহীত

নিজের ও পরিবারের নামে জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অস্বাভাবিক পরিমাণ সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে কিছুদিন ধরে ব্যাপক আলোচনায় আছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। এখন বিপুল সম্পদ অর্জন নিয়ে আলোচনায় এসেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিমএপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যান।

আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয় ঈদুল আজহার আগের দিন রোববার ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার খবরকে কেন্দ্র করে। ওই খবরে বলা হয়, পুলিশের সাবেক এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুটি ফ্ল্যাট, ছেলের নামে একটি বাড়ি এবং মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ৬৭ শতক জমি রয়েছে। এই তিন জেলায় তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে আরও ১৬৬ শতক জমি।

আরও পড়ুন

যদিও আছাদুজ্জামান মিয়া ১৬ জুন মুঠোফোনে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তাঁর সব সম্পদ বৈধ আয়েই কেনা। তাঁর ছেলে ও মেয়ের নামে যেসব সম্পত্তির কথা বলা হয়েছে, সেটা অর্জনের সামর্থ্য তাঁরা রাখেন। এগুলো তাঁর বৈধ আয়ের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠা জমির ওপর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামানের মালিকানায় ছয়তলা একটি বাড়ি রয়েছে। রাজধানীর ইস্কাটনেও আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ধানমন্ডিতে। এর বাইরে সিদ্ধেশ্বরীতে আছাদুজ্জামানের মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গাজীপুরের কালীগঞ্জের চাঁদখোলা মৌজায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সর্বমোট ১০৬ শতক জমি কেনা হয় আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় আফরোজার নামে ২৮ শতক জমি কেনা হয়। একই বছর একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনা হয় তাঁর নামে। পূর্বাচলে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামান মিয়ার নামে। এ ছাড়া আছাদুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীর আফতাবনগরে ২১ কাঠা জমি রয়েছে। নিকুঞ্জ-১-এ আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলের নামেও একটি বাড়ি রয়েছে।

আরও পড়ুন

এসব সম্পদের বিষয়ে ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, স্ত্রীর নামে থাকা বাড়িটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর মেয়ে চিকিৎসক, জামাতাও চিকিৎসক। তাঁরা বৈধ আয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এ ছাড়া যেসব জমির কথা বলা হচ্ছে, তা–ও বৈধ আয়ে কেনা। তাঁদের যত সম্পদ, সেটি আয়কর বিবরণীতে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

পুলিশের সাবেক এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর স্ত্রী এবং তিনি অনেক সম্পদের মালিক। তাঁর এক ছেলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরি করেন। ছেলের বউ একটি ব্যাংকে উচ্চ বেতনে চাকরি করেন। তাঁর স্ত্রীরও বুটিকের ব্যবসা রয়েছে। আফতাবনগরে ২১ কাঠার প্লটের মধ্যে ৭ কাঠা ছাড়া বাকি জমির মালিক আছাদুজ্জামানের দুই শ্যালিকা।

এদিকে অল্প সময়ের ব্যবধানে পুলিশের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিপুল সম্পদের মালিকানা অর্জনের বিষয়টি নিয়ে বাহিনীটির মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, পরিকল্পিতভাবে এই বিষয়গুলো সামনে আনা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে অবসরের পর অনেক কর্মকর্তা বিপদে পড়তে পারেন।

আরও পড়ুন

বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বেনজীর আহমেদ ও আছাদুজ্জামান মিয়ার অস্বাভাবিক সম্পদের মালিকানার বিষয়গুলো সামনে আসায় সবচেয়ে আতঙ্কে আছেন দুর্নীতিতে জড়ানো কর্মকর্তারা। এ জন্য এ–সংক্রান্ত আলোচনাকে তাঁরা ব্যক্তির দুর্নীতির পরিবর্তে বাহিনীর ভাবমূর্তির বিষয় বলে সামনে আনার চেষ্টা করছেন। ভবিষ্যতে যেন এমন আর কোনো কর্মকর্তার সম্পদ অর্জনের বিষয়গুলো সামনে না আসে, এ জন্য করণীয় নিয়ে ভাবছেন কেউ কেউ। এ জন্য কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বসে আলাপ–আলোচনার চিন্তা করছেন বলেও জানান একাধিক কর্মকর্তা।

পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদের মালিকানার বিষয়টি সামনে আসার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করেছে। এর মধ্যেই গত ৪ মে তিনি সপরিবার দেশ ছাড়েন। পরিবারসহ তাঁকে তলবও করেছে দুদক।

বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকায় মোট ১২টি ফ্ল্যাট, দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৯৭ বিঘা জমি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর বাইরে আদালতের নির্দেশে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, একটি বেসরকারি টেলিভিশনসহ দুটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এবং ৩টি বিও হিসাবও (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

এ অবস্থায় বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের মালিকানা নিয়ে দুদক কী ভূমিকা রাখবে? দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান মনে করেন, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ডিএমপির সাবেক এই কমিশনারের সম্পদের তথ্য যাচাই করা উচিত।

আরও পড়ুন

খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, একজন সরকারি চাকরিজীবী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাবর সম্পদ থাকার যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, সেটি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে এসব সম্পদের উৎস বের করা দরকার। আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব শেষে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ জাতীয় নিরাপত্তা–সংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে আছাদুজ্জামান মিয়াকে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এ কারণে পুলিশের এই সাবেক অতিরিক্ত আইজিপির বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও আলোচনা তৈরি হয়েছে।

গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তেমন অভিযোগ আসেনি। তবে দুর্নীতি হলে তদন্ত হবে, বিচার হবে। তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন, দুদকও স্বাধীন। যে যত প্রভাবশালী হোন, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করা যাবে। তদন্ত শেষে মামলা করা যাবে, মানে বিচারের আওতায় আসবে।

আরও পড়ুন