রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, সার, গম ইত্যাদি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ইতিমধ্যেই অনেক বেড়েছে। ভবিষ্যতেও এই ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকবে। এতে বাংলাদেশে টাকার আরও অবমূল্যায়ন, আরও মূল্যস্ফীতি এবং আরও অর্থনৈতিক দুর্ভোগ অব্যাহত থাকবে।
‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: পথের শেষ কোথায়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সভার আয়োজন করে সমাজ গবেষণা কেন্দ্র।
অনুষ্ঠানে ‘পথের শেষ কোথায়: ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ও পাশ্চাত্য এবং বাংলাদেশের জন্য এর তাৎপর্য’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিনায়ক সেন। এতে তিনি বলেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে সৃষ্টি হয়েছে প্রবল চাপ। গ্যাসের অভাবে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাড়তি গ্যাস আমদানির মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে কি না, এ নিয়েও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ‘অকার্যকর’ হয়েছে বলে মনে করেন বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, অকার্যকর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশকে আরও বেশি চড়া মূল্যে তেল-গ্যাস-খাদ্যশস্য-সার-ভোজ্যতেল প্রভৃতি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এতে রাশিয়া ও চীন উভয় দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয়ে বাংলাদেশকে আরও হিসাব কষে এগোতে হবে।
ভারত, চীন বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশের মতো বড় ধরনের দর-কষাকষির শক্তি না থাকায় বাংলাদেশ উভয়সংকটে আছে উল্লেখ করে বিনায়ক সেন বলেন, যেভাবে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, তাতে রাশিয়া ও চীন উভয় দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক নির্ণয়ে বাংলাদেশকে আরও হিসাব কষে এগোতে হবে।
বিনায়ক সেন বলেন, ‘বাংলাদেশ সাহস করে রাশিয়ার সঙ্গে সরবরাহ চুক্তিতে যেতে পারছে না, যে অবস্থানে ভারত গোড়া থেকেই আছে। আমরা ভয় পাচ্ছি, ও রকম পদক্ষেপ নিতে গেলে পাছে আমাদের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা চলে আসে। পাছে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যার ফলে এই মন্দার বছরে আমরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যেটুকু বাড়তি সহানুভূতি পাশ্চাত্য থেকে আশা করতে পারি, সেটুকুও না হাতছাড়া হয়ে যায়। এই একই কারণে আমরা খুব বেশি চীনমুখী অর্থনৈতিক নীতিও গ্রহণ করতে পারব না।’
বিনায়ক সেন বলেন, এ অবস্থায় দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের উচিত পশ্চিমের সব রাষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ করে প্রতিবাদ জানানো। রাষ্ট্রদূতদের এ কথা বলা যে এই অকার্যকর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে এবং কতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিবাদ ওঠা উচিত বৃহত্তর নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজের পক্ষ থেকেও।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভারতের পক্ষে যা করা সম্ভব, তা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সে জন্য রাশিয়া থেকে ১৫ শতাংশ কমে ভারত তেল আনলে, ভারতের কাছ থেকে বাণিজ্য চুক্তি করে আমরা ১০ শতাংশ কমে তা আনতে পারি।’
সভায় আরও বক্তব্য দেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ, বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য দিলীপ নাথ, বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান প্রমুখ।