হাওরে ইজারাপ্রথা বাতিল করা উচিত: ফরিদা আখতার
কোনোভাবেই হাওরকে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। হাওরের প্রাণ, প্রকৃতি রক্ষায় যা করণীয়, তা করা হবে। হাওরে ইজারাপ্রথা মানুষের জীবন-জীবিকার পক্ষে ক্ষতিকর। তাই এ প্রথা বাতিল করা উচিত বলে হাওর সংলাপে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানবাধিকার সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় হাওর সংলাপ-২০২৪। পরিবেশ, প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন এএলআরডি, বারসিক ও বেলা যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে। এতে সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরাঞ্চলের কৃষক, জেলে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, উন্নয়ন ও নাগরিক সংগঠন, সাংবাদিক ও হাওর এলাকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তাঁরা হাওর এলাকার বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন এবং এসব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সুপারিশ করেন। সংলাপে দুটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, হাওর অঞ্চলের সমস্যা সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। তা ছাড়া ধারণাপত্র এবং উপস্থিত বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনের আলোচনা থেকে সমস্যাগুলো সম্পর্কে আরও সম্যক ধারণা পেয়েছেন। তবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, হাওর এলাকা নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পারস্পরিক টানাপোড়েন রয়েছে। এই ভাগাভাগি, ঠেলাঠেলির জন্য কেউ ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। হাওরের পানিপ্রবাহ, বাঁধ নির্মাণ—এসব দেখভালের দায়িত্ব পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। আবার সেখানকার ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ দেখভাল করে কৃষি মন্ত্রণালয়। মাছ ও প্রাণসম্পদের বিষয়টি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। ফলে হাওরের উন্নতির জন্য সার্বিকভাবে কাজ করতে হলে যে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, তা সম্ভব হচ্ছে না। এটা একটা বড় অন্তরায়। তবে এখন এসব দূর করার সময় এসেছে। কোনো ঠেলাঠেলি আর গ্রহণযোগ্য হবে না। সবাইকে দায়দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
সংলাপে হাওর এলাকায় দেশি মাছের প্রজাতি রক্ষা ও প্রকৃত জেলেদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার জন্য ইজারাপ্রথা বাতিলের প্রবল দাবি ওঠে। এ প্রসঙ্গে প্রধান অতিথি ফরিদা আখতার বলেন, নীতিগতভাবে তিনিও ইজারাপ্রথা বাতিলের পক্ষে। তবে এর সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয় জড়িত। তিনি তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। তবে দেশি মাছের প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য হাওর এলাকায় মাছের অভয়ারণ্য করা এবং মা মাছের সুরক্ষায় জন্য বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত তিন মাস হাওরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ কারার যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবেন তিনি।
প্রধান অতিথি বলেন, অতীতে জনস্বার্থ, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের গুরুত্ব উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় বহু উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে। এতে শুধু অর্থের অপচয়ই হয়নি, পরিবেশ–প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতিও হয়েছে। যেমন হাওরাঞ্চলের ইটনা-মিঠামইন সড়ক করা হয়েছিল জনস্বার্থ ও পরিবেশের বিষয়টি উপেক্ষা করে। এখন এটি বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। সড়কটি অপসারণের বিপুল দাবি উঠছে। হাওরের ভেতর দিয়ে আড়াআড়িভাবে তৈরি করা এ সড়কের বিভিন্ন স্থানে কেটে বা বিকল্প ব্যবস্থা করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করা হবে। এটা করতেও এখন রাষ্ট্রের বহু অর্থ খরচ করতে হবে।
সংলাপে ‘হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানবাধিকার সুরক্ষা’ শীর্ষক ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন গবেষক সৈয়দ আলী বিশ্বাস এবং ‘প্রস্তাবিত বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২২’ বিষয়ে প্রাথমিক মতামত ও ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন এএলআরডির গবেষক সানজিদা খান।
দেশের ৭টি জেলায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। এর আয়তন প্রায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর। হাওরাঞ্চলে ১৪৩ প্রজাতির দেশি মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ, কয়েক প্রজাতির মিঠাপানির চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রকার ছোট-বড় মাছ, শামুক, ঝিনুক রয়েছে।
সংলাপে বক্তারা বলেন, হাওর হচ্ছে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় এলাকা। ধান চাষের প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে এখানে দেশি মাছ ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব উপেক্ষা করা হয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মাছ ও জলজ জীবের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। দেশি মাছের উৎপাদন কমছে। অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। অপরিকল্পিত বাঁধ এবং উজান থেকে আসা বালুর কারণে হাওরের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য হাওরে গভীর খননের প্রয়োজন। আলোচকেরা বলেন, হাওর যদি একবার হারিয়ে যায়, তবে তাকে আর ফেরানোর কোনো উপায় থাকবে না। যেকোনো মূল্যে হাওর রক্ষা করতে হবে।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী শামসুল হুদার সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন রংপুর বিভাগের পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক রফিকুল ইসলাম, শেয়ার দ্য প্ল্যানেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট তেৎসু চুচুই, বেলার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নির্বাহী সভাপতি ডা. লেনিন চৌধুরী, অধ্যাপক আফজালুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিবেশ ও বন শাখার উপপ্রধান বেলাল উদ্দীন বিশ্বাস প্রমুখ। সংলাপ সঞ্চালনা করেন বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ।