বিআইডব্লিউটিসি
লাভজনক প্রতিষ্ঠান এখন লোকসানে
পদ্মাসহ কয়েকটি সেতু চালুর পর ফেরিতে যানবাহন কমে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির গত অর্থবছরে আয় কমেছে ৯৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দীর্ঘদিন ধরে লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তাদের আয়ের প্রধান উৎস ফেরিতে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আয়ের ৯৪ শতাংশই এসেছিল ফেরি খাত থেকে। তবে এই খাতে আয় ব্যাপক হারে কমে গেছে। এতে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরে ফেরি খাতে আয় কমেছে ২৩ শতাংশ, যার পরিমাণ ৯৩ কোটি টাকা। এতে ওই অর্থবছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়েছে ৩৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর আগে কখনো তারা এত বড় লোকসানে পড়েনি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত কয়েক বছরে পদ্মাসহ কয়েকটি সেতু চালু হওয়ায় ফেরি খাতে বিআইডব্লিউটিসির আয় কমছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিআইডব্লিউটিসিকে লোকসান থেকে তুলে আনা কঠিন হবে। কারণ, আয়ের প্রধান উৎস ফেরি খাত সংকুচিত হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এই খাতে আয় আরও কমতে পারে। কারণ, ফেরিতে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার নিয়মিত কমছে।
১৩ অর্থবছরের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে বিআইডব্লিউটিসি প্রথম লোকসানে পড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৬ কোটি টাকা লোকসান হয়। পরের বছর লাভ করলেও গত দুই অর্থবছর টানা লোকসান দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিআইডব্লিউটিসিকে লোকসান থেকে তুলে আনা কঠিন হবে। কারণ, আয়ের প্রধান উৎস ফেরি খাত সংকুচিত হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এই খাতে আয় আরও কমতে পারে। কারণ, ফেরিতে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার নিয়মিত কমছে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতে একসময় ফেরিপথে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হতো। ২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালুর পর এই পথে যাতায়াতের অন্যতম নৌপথ শিমুলিয়া-বাংলাবাজার-মাঝিরকান্দি বন্ধ হয়ে যায়।
বিআইডব্লিউটিসি জলযানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফেরি, ৫৯টি। এ ছাড়া ঘাটবার্জ, রিসিভিং ফ্লাট, পন্টুন জলযান ৪২টি, ২০টি যাত্রীবাহী জাহাজ, ১৭টি কোস্টাল জাহাজ, ১৭টি কার্গো বা কনটেইনারবাহী জাহাজ রয়েছে। রয়েছে ক্রেনবোট, মোটরলাইফ বোট, হারবার ডিউটি লঞ্চ ইত্যাদি।
এ ছাড়া দেশে আরিচা-কাজীরহাট, চাঁদপুর-শরীয়তপুর, ভোলা-লক্ষ্মীপুর, লাহারহাট-ভেদুরিয়া, ধাওয়াপাড়া-নাজিরহাট ও রৌমারী-চিলমারীতে ফেরিসেবা রয়েছে। তবে এসব ফেরিপথে যানবাহন পারাপার তুলনামূলক কম।
অবশ্য ফেরিতে যানবাহন চলাচল কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিসির লোকসানের জন্য কয়েক দফায় তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমান।
জানা যায়, ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর এ পর্যন্ত তিনবার জ্বালানির দাম বেড়েছে। একই সময়ে জ্বালানির সঙ্গে সমন্বয় করে দুই দফায় ৪০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে বিআইডব্লিউটিসি।
কর্মকর্তারা বলছেন, নানা অজুহাতে বিআইডব্লিউটিসির কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এসব কারণেও প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
শতকোটি বিনিয়োগের পরও লোকসান
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিপিং করপোরেশন ও ৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বায়ত্তশাসিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসি। প্রতিষ্ঠানটির কাজ অভ্যন্তরীণ, উপকূলীয় ও আন্তর্জাতিক নৌপথে যাত্রী-পণ্য পরিবহন ও যানবাহন পারাপার। যাত্রাকালে প্রতিষ্ঠানটির মোট জলযান ছিল ৬০৮টি। কমতে কমতে বর্তমানে জলযানের সংখ্যা ১৮২। এর মধ্যে আবার ৫৫টি জলযান বিক্রি অথবা মেরামতের চেষ্টা চলছে। একটি সূত্র জানায়, এর মধ্যে অন্তত ১৪টি জলযান বিক্রি হয়ে গেছে।
বিআইডব্লিউটিসি জলযানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফেরি, ৫৯টি। এ ছাড়া ঘাটবার্জ, রিসিভিং ফ্লাট, পন্টুন জলযান ৪২টি, ২০টি যাত্রীবাহী জাহাজ, ১৭টি কোস্টাল জাহাজ, ১৭টি কার্গো বা কনটেইনারবাহী জাহাজ রয়েছে। রয়েছে ক্রেনবোট, মোটরলাইফ বোট, হারবার ডিউটি লঞ্চ ইত্যাদি।
বিআইডব্লিউটিসি বলছে, তারা আয় বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন রুটে ফেরিসেবা চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে। লোকসান কাটিয়ে উঠতে পুরোনো ও লোকসানি জাহাজ বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত নভেম্বরে বিআইডব্লিউটিসির বহরে ছয়টি নতুন ফেরি যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া সরকার গত ১৪ বছরে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফেরি, জাহাজসহ মোট ৭০টি জলযান বানিয়েছে। আরও শতকোটি টাকা ব্যয়ে জলযান নির্মাণের কাজ চলছে।
এত বিনিয়োগের পরও বিআইডব্লিউটিসি লাভে ফিরবে—এমন সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, জলযান কেনা-মেরামত ও জ্বালানির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ের বড় একটি অংশ চলে যায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মোট জনবল ছিল ২ হাজার ৮৩৮ জন। এর মধ্যে ১৪০ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা।
বিআইডব্লিউটিসিকে পরিবর্তনের কথা চিন্তা করতে হবে। নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।আহমদ শামীম আল রাজী, বিআইডব্লিউটিসির সাবেক চেয়ারম্যান
লোকসানের আরেক কারণ দুর্নীতি
গত ১৬ জানুয়ারি দিবাগত রাত একটার দিকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ছোট আকারের ফেরি রজনীগন্ধা ছেড়ে আসে। ঘন কুয়াশায় ঘাট দেখতে না পেয়ে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটের কাছেই ফেরিটি নোঙর করা হয়। ১৭ জানুয়ারি সকাল আটটার দিকে যানবাহনসহ ফেরিটি ডুবে যায়।
ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির একটি সূত্র জানায়, ফেরিটির বিভিন্ন জায়গায় হালকা ছিদ্র ছিল। যানবাহন নিয়ে দীর্ঘ সময় নদীতে থাকায় ছিদ্র দিয়ে পানি ঢুকে ফেরিটি ডুবে যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ফগলাইট থাকলে হয়তো ঘাটে ভিড়তে পারত ফেরিটি।
জানা গেছে, ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল সচল রাখতে ২০১৬ সালে বিআইডব্লিউটিসি ৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি সার্চ অ্যান্ড ফগলাইট কিনেছিল। তবে শুরু থেকেই ফগলাইট কাজ করছিল না।
পাটুরিয়া ফেরিঘাটের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম, মেরিন) আহমেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ফগলাইট শুরু থেকেই কাজ করছিল না। তাই সেগুলো ব্যবহার করা হয় না।
এ ঘটনায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি মামলা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, সার্চ ও ফগলাইটের বদলে নিম্নমানের সার্চলাইট সরবরাহ করা হয়েছে। ঠিকাদার ও বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সরকারের ৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে নানা অজুহাতে বিআইডব্লিউটিসির কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এসব কারণেও প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিসির কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকে মামলা আছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বিআইডব্লিউটিসি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেওয়া এক চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, দরপত্র ছাড়া জাহাজ মেরামতসহ জাহাজ খাতে নানা অনিয়ম করে কিছু কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। একটি ফেরিঘাট ইজারার দরপত্রে ২২ লাখ টাকা ডাক উঠলেও মাত্র ৯৬ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতিতেও অনিয়মসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে।
অবশ্য বিআইডব্লিউটিসি বলছে, দুর্নীতির নজরদারিতে সব স্তরে ভিজিলেন্স টিম আছে। সর্বত্রই তারা মনিটর করে।
অন্যান্য সেবাও ধুঁকছে
বিআইডব্লিউটিসির আরও কিছু সেবা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম নৌপথে যাত্রী পরিবহন। ঢাকা-খুলনা নৌপথে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। নাব্যতা–সংকটের কারণে খুলনার পরিবর্তে ঢাকা-মোরেলগঞ্জ রুটে যাত্রীসেবা চালু রাখে বিআইডব্লিউটিসি। ২০২১-২২ অর্থবছরেও এই রুটে বিআইডব্লিউটিসির পাঁচটি জাহাজ ছিল। পদ্মা সেতু চালুর পর অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ পরিচালনার জন্য বিআইডব্লিউটিসি ৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১২টি ওয়াটারবাস নামায়। এখন এই সেবাও বন্ধ।
সাগরপথে দ্বীপ অঞ্চলে যাত্রী পারাপারের সেবাও রয়েছে বিআইডব্লিউটিসির। এই সেবাও এখন অনেকটাই সংকুচিত। এখন কেবল চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ-হাতিয়া এবং কুমিরা-গুপ্তছড়া পথে উপকূলীয় যাত্রীসেবা চালু রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এই দুই রুটে মাত্র একটি করে জাহাজ চলে।
বিআইডব্লিউটিসির কার্গো সেবা একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই বহরে নৌযান ছিল ৩৬টি। এখন বহরে কার্গো আছে মাত্র ৭টি। চট্টগ্রাম-নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম-মোংলা, নারায়ণগঞ্জ-কলকাতা এবং চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে চলাচল করছে।
১৯২০ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে চারটি ডকইয়ার্ড করা হয়। এ ছাড়া আরেকটি ফ্লোটিং ডক রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। এসব ডকইয়ার্ডে প্রতিষ্ঠানটির জলযান মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য কাজ করা হয়। জরুরি মেরামতের জন্য আরিচা, মাওয়া, বরিশাল, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও ঢাকা ঘাটে ঘাঁটি কারখানা রয়েছে। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এসব ডকইয়ার্ড ও ঘাঁটিতে অন্য কারও জলযান মেরামত বা নির্মাণ করা হয় না।
নতুন বাজার তৈরি ছাড়া ‘বিলুপ্তির’ শঙ্কা
বিআইডব্লিউটিসি বলছে, তারা আয় বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন রুটে ফেরিসেবা চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে। লোকসান কাটিয়ে উঠতে পুরোনো ও লোকসানি জাহাজ বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহার করে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যেমন প্রধান কার্যালয় ফেয়ারলি হাউসে নতুন ভবন নির্মাণ, ডকইয়ার্ডগুলোর আধুনিকায়ন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে জেটি নির্মাণ, নতুন জাহাজ নির্মাণের মাধ্যমে আয় বাড়ানোর চেষ্টা রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন সেবা চালু করা হবে।
অবশ্য বিআইডব্লিউটিসির কেউ কেউ বলছেন, ফেরির পাশাপাশি নতুন সেবা যুক্ত না করতে পারলে কেবল লোকসান নয়, ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে পণ্য পরিবহনে ভালো করার সুযোগ রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসির সাবেক চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী প্রথম আলোকে বলেন, বিআইডব্লিউটিসিকে পরিবর্তনের কথা চিন্তা করতে হবে। নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। উপকূলীয় এলাকার মানুষের পারাপারে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।