বাজার ভরা হরেক খেজুর, তবে দাম চড়া
পবিত্র মাহে রমজান সমাগত। সারা দিন পানাহারে বিরত থেকে সিয়াম সাধনার পর ইফতারে খেজুর মুখে দেন প্রায় সবাই। খেজুরের সঙ্গে অবশ্য সিয়াম সাধনার কোনো ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা বা বিশেষ তাৎপর্য নেই। তবু এক প্রকারের ভাবাবেগ কাজ করে রোজাদারদের মনমানসে যে এই ফল দিয়ে ইফতার করতেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। কাজেই ইফতারে ফলটি মুখে দেওয়া সুন্নত। সে কারণেই রমজান মাসে বাংলাদেশে খেজুরের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে যেহেতু সুস্বাদু খেজুর হয় না, তাই সবই আমদানি করতে হয়। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসে প্রায় ২০ ধরনের খেজুর। তবে দাম এবার বেশ চড়া। গত বছরের চেয়ে এবার ২০০ থেকে আড়াই শ টাকা বেড়েছে কেজিতে।
সবচেয়ে দামি খেজুর সৌদি আরবের ‘মেডজুল’। এটা দুই রকমের আছে বাজারে। আকারে বড়, প্রায় দেড় থেকে দুই ইঞ্চি লম্বা ‘জাম্বো মেডজুল’ নামে পরিচিত এই খেজুরের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি। গত বছর ছিল ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি। সাধারণ মেডজুল এবার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা কেজি, যা গত বছর ছিল ৮০০ টাকা। এরপর রয়েছে সৌদি আরবের ‘মাবরুম’ ও ‘আজওয়া’। ভালো মানের মাবরুম খেজুরের দাম এক হাজার টাকা কেজি। একটু নিম্নমানের মাবরুম কেনা যাবে ৯০০ টাকায়। ভালো মানের আজওয়ার দামও ১ হাজার টাকা কেজি, তবে সর্বনিম্ন পাওয়া যাবে ৮০০ টাকায়।
সরবরাহ পর্যাপ্ত, তবে দাম বাড়তি
কথা হলো কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর ফল বিতানের ব্যবসায়ী নূর ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, খেজুরের দাম এবার গত দুই বছরের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রতিবছরই রোজার সামনে খেজুরের দাম কিছুটা বাড়ে। তবে এ বছর দাম বেড়েছে অতিরিক্ত। প্রতি কেজিতে আড়াই শ টাকা থেকে নিম্নে ৫০ টাকা পর্যন্ত। দামি ও মধ্যম দামের খেজুরের দামই বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
খেজুরের দাম বাড়লেও বাজারে সরবরাহ রয়েছে পর্যাপ্ত। আমদানিও হয়েছে চাহিদা অনুসারেই। ঘাটতি পড়বে না বলেই প্রথম আলোকে জানালেন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পুরান ঢাকার বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। তিনি বললেন, দেশে রমজানের সময়ই খেজুরের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এবার এই পরিমাণই আমদানি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরেও কোনো জট ছিল না। জাহাজ ভিড়তে পেরেছে সময়মতোই। ফলে বাজারে খেজুরের সংকট হবে না।
দ্রব্যমূল্য হররোজ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে সাধ–সাধ্যের সমন্বয় করা দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের পক্ষে।
তবে ডলারের দাম বাড়ায় মানভেদে খেজুরের দাম কেজিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে। তিনি বললেন, আগে ডলারপ্রতি বাংলাদেশি ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা পরিশোধ করতেন। এবার দিতে হচ্ছে ১০৮ থেকে ১১০ টাকা। এলসি খোলার তিন মাস পর দাম পরিশোধ করতে হবে। তখন যদি ডলারের দাম আরও বেড়ে যায়, তাহলে তাঁদের বেশ বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে।
তিন রূপে মরিয়ম
ফলের বাজার ঘুরে দেখা গেল, অভিজাত শ্রেণির খেজুরের মধ্যে মেডজুল ও আজওয়ার পরই রয়েছে ‘মরিয়ম’–এর অবস্থান। সৌদি আরব, ইরান, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও মিসরের মরিয়ম খেজুরগুলো বেশ চালু। মানভেদে এর দামেও রকমফের রয়েছে। সবচেয়ে ভালো মানের মরিয়ম খেজুরের দাম ৯০০ টাকা ৯৫০ টাকা কেজি। গত বছর এর দাম ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। এগুলোর রং উজ্জ্বল বাদামি, লম্বাটে আকার, প্রায় দেড় ইঞ্চির মতো লম্বা। স্বাদ খুবই মিষ্টি।
আরেক প্রকার মরিয়ম খেজুর ‘কালমি মরিয়ম’, এগুলো একটু গাঢ় বাদামি, প্রায় কালচে রঙের। দেখতে খানিকটা ডিম্বাকৃতির। এর দাম ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। এগুলো মূলত মিসর, জর্ডান ও আলজেরিয়ার খেজুর। গত বছর এর দাম ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা ছিল।
একটু হালকা বাদামি রঙের একধরনের মরিয়ম আছে। এর নাম ‘সুফরি মরিয়ম’, দাম ৬৫০ টাকা কেজি। কারওয়ান বাজারের ফলের দোকান ও ফুটপাতের পসরা ঘুরে দেখা গেল, মরিয়ম খেজুর এবার সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা কেজিতে কেনা যাবে, তবে মান ততটা ভালো হবে না। গত বছর নিম্ন দামের মরিয়ম পাওয়া যেত ৩৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।
ফুটপাতেও আছে খেজুরের পসরা
ফলের দোকানগুলোতে অন্যান্য তাজা মৌসুমি ফলের পাশাপাশি স্বচ্ছ পলিথিনে মোড়ানো খেজুরের প্যাকেটগুলোই এখন প্রধান স্থান দখল করে আছে। তা ছাড়া শুধুই হরেক রকমের খেজুরের পসরা বসেছে মহানগরীর ফুটপাতজুড়েই। কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের সামনের সড়কে শুধু খেজুর নিয়েই প্রায় ডজনখানেক আলাদা আলাদা পসরা সাজিয়েছেন বিক্রেতারা। তাঁদের মধ্যে মো. মাসুম ও আরমান হোসেন জানালেন, প্রায় ২০ থেকে ২৫ ধরনের খেজুর রয়েছে এসব পসরায়। প্রকারভেদে এসব খেজুর তিন ধরনের। ‘শুকনা’, ‘ভেজা’ ও ‘ডাল’ খেজুর। একেবারে শুকনা খেজুরের দাম তুলনামূলক বেশি। একটু নরম ধরনের খেজুরকে বলে ‘ভেজা খেজুর’। আরেক রকম খেজুর আছে ডালসমেত। এগুলো সাধারণত প্যাকেট বিক্রি হয়।
আছে ‘জুয়েল’, ‘রয়্যাল’
দরদামের খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এবার ‘আম্বার’ ও ‘সাফাভি’ নামের দুই ধরনের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা কেজি। এর দাম গত বছর ছিল ৬৫০ টাকা। এ ছাড়া যেসব খেজুর পাওয়া যাচ্ছে, এর মধ্যে আছে ‘সুক্কারি’ ৭৫০ টাকা কেজি, ‘আদম’ ৬০০ টাকা, জর্ডানের ‘জুয়েল’ ৭০০ টাকা, আলজেরিয়ান ‘রয়্যাল’ ৫০০ টাকা, ‘মাশরুক’ ৪৫০ টাকা, ‘আলজেরিয়ান খেজুর’ ৩৬০ টাকা, ‘দাবাস ক্রাউন’ ৩৪০ টাকা, ‘দাবাস প্লেন’ ৩০০ টাকা। ‘বরই খেজুর’ নামে গোলাকার এক রকমের খেজুরও বেশ বিক্রি হয়। বড় আকারের বরই খেজুর প্রতি কেজি ৪৩০ টাকা ও ছোটগুলো ২২০ টাকা। গত বছর এর দাম ছিল যথাক্রমে ৩০০ ও ১৫০ টাকা কেজি। ফিকে হলুদ রঙের খানিকটা গোলাকৃতির দুবাইয়ের ‘জাহিদি’ খেজুরের দামই সবচেয়ে কম ১৫০ টাকা, গতবার এর দাম ছিল ৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। এসব খেজুর আসে কাগজের কার্টনে।
এ ছাড়া আরেক ধরনের খেজুর আছে বাজারে, এটার চলতি নাম ‘গলা খেজুর’। এগুলো আসে বস্তায়। নরম খেজুর। এবার ফুটপাতে এর সর্বনিম্ন দামই ১৩০ টাকা কেজি।
এসবের বাইরে আরেক রকম খেজুর আছে সুদৃশ্য কাগজের প্যাকেট বা প্লাস্টিকের বাক্সে ভরা। এতে সাধারণত আধা কেজি খেজুর থাকে। মানভেদে এগুলো বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন আড়াই শ টাকা থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা পর্যন্ত।
পড়তায় না হলে কিনছেন কম
কারওয়ান বাজারে আজ দুপুরে খেজুর কিনতে এসেছিলেন রামপুরার আসাদুল হক। তিনি রেটকো লিমিটেড নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক। বললেন, মরিয়ম খেজুর কিনতে চান। তিউনিসিয়ার মরিয়ম ৭০০ টাকা করে চাইছেন দোকানিরা। তিনি দুই কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা বলেছেন। একটু ঘুরে দেখেছেন, দুই কেজিতে সর্বোচ্চ আরও ১০০ টাকা তিনি বাড়াতে পারেন। আসাদুল বলেন, খেজুর এ দেশে হয় না। পুরোটাই আমদানিনির্ভর, ডলারের দাম বেশি, তার ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স আছে। এবার দাম কিছুটা বাড়বে, এটা ভেবেই কিনতে এসেছেন। তবে যা মনে করেছিলেন, দাম তার চেয়ে অনেক বেশি মনে হচ্ছে। ফলে পড়তায় না পড়লে পরিমাণে কম কিনতে হবে বলে জানালেন তিনি।
বাস্তবতা হলো এটাই। দ্রব্যমূল্য হররোজ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে সাধ–সাধ্যের সমন্বয় করা দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের পক্ষে।