হাওর-সংস্কৃতির নানা মুখ
গেল বছরের বর্ষায় সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে গিয়েছিলাম। আগের রাতের ঝমঝম বৃষ্টি আলো ফোটার আগেই থেমে গিয়েছিল। ভোরের স্নিগ্ধতা কেটে গেলে পানিতে নামলাম। চারপাশ সুনসান। দূরের মেঘালয়ের সারি সারি পাহাড় দেখা যাচ্ছে। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে কালো মেঘেরা। পাহাড়ের বুক চিরে নামছে ঝরনার পানি। পশ্চিম দিকে ছুটে চলা জেলেদের হস্তচালিত এক নৌকা থেকে ভেসে এল পুরুষ কণ্ঠ, ‘সুজন বন্ধু রে, আরে ও বন্ধু, কোন বা দেশে থাকো/অভাগীরে কান্দাইয়া কোন নারীর মন রাখো সুজন বন্ধু রে।’
সাতসকালে হঠাৎ এমন বিচ্ছেদি গানে মন উতলা হয়। এ গান আমাকে নিয়ে চলে অতীতে, নয়ের দশকের গোড়ায়। মালজোড়াগানের আসরে শিল্পীদের পাল্টাপাল্টি বাতচিত আর গানে পার হওয়া রাতভোরের পর এ রকমই এক সকাল ছিল। সেদিন নিজ উপজেলা শাল্লায় ‘সুজন বন্ধু রে’ গানটি শুনেছিলাম প্রখ্যাত বাউল শিল্পী মো. শফিকুন্নূরের কণ্ঠে। তিন দশকের ব্যবধানে অচেনা এক জেলের কণ্ঠের আকুলতা মুহূর্তেই আমাকে কৈশোরের স্মৃতির স্পর্শ এনে দেয়। যেন নিঃসঙ্গতা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে, হাওরের পানিতে।
হাওরের গান তো এমনই, মায়ামাখা। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওর-অধ্যুষিত প্রায় প্রতি বাড়িতেই গানের চাষবাস হয়, ঐতিহ্যপরম্পরায় শিল্পী-গীতিকারেরা এখানে আপনাআপনিই জন্মে। অসংখ্য লোকগান আর লোকনাট্যের ধারার উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে হাওরাঞ্চলে। এর মধ্যে ঘেটুগান, মালজোড়াগান, ধামাইলগান, ভট্টসংগীত, ঢপযাত্রা উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে বাউল, কীর্তন, সূর্যব্রত, জারি, মুর্শিদি, সারি, ভাটিয়ালি, বারোমাসি, ফকিরিগান, মালসি, হোরিগান, গাজীর গান, পদ্মপুরাণের গান, যাত্রাগানসহ নানা ধরনের গানের প্রচলন রয়েছে।
হাওরের বিচিত্র সব গানের ধারার পাশাপাশি গ্রামীণ চিরায়ত সংস্কৃতির অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গেও গান আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে এখনো এখানে মূল আকর্ষণ গান। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে কৃষি উৎপাদনের সময় নানামুখী লোকাচারেও গানের ব্যবহার রয়েছে। হালচাষ, বীজ রোপণ, ফসল কাটা থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত নানা রকম উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে আনুষঙ্গিক লোকাচার হিসেবে পরিবেশিত হয় গান। কৃষক ছাড়া জেলে, কামার, কুমার থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষও লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসার করছেন।
হেমন্তে যে বছর ফসল ভালো জন্মায়, সে বছর খুব ঘটা করে উৎসব হয়। লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, কুস্তি-খেইড়সহ কত আয়োজনই না হয় তখন। বর্ষায় বাড়িতে বাড়িতে চলে বিয়ের আয়োজন। সে আয়োজনে নেচে, গেয়ে নারীরা মুখর করে তোলেন পুরো গ্রাম। জাতপাত, বৈষম্য আর ভেদাভেদ ভুলে আনন্দযজ্ঞে গা ভাসা হাওরের সব মানুষ। এক গ্রামের যশস্বী শিল্পীর ডাক পড়ে আরেক গ্রামে।
যশস্বী শিল্পীর কথা যখন এলই, তখন সত্তরোর্ধ্ব শান্তি রানী সরকারের কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জ সদরের ইছবপুর গ্রামে। কিংবা সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ ধড়েরপার গ্রামের পয়ষট্টির্ধ্ব প্রমিলা রানী সরকারের গল্পও বলা যায়। তাঁরা দুজনই ‘পদ্মপুরাণ’–এর গান গেয়ে বেড়ান। প্রথমজন ষাট বছর আর দ্বিতীয়জন পঞ্চাশ বছর ধরে গানের জগতে আছেন। গেল ১৪২৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসের পঞ্চমী তিথিতে আয়োজন করা মনসাপূজায় পদ্মপুরাণের গান গাইতে হাওরের এই দুই ডাকসাইটে শিল্পী সিলেট শহরের শিবগঞ্জে এসেছিলেন।
তখনই আলাপ হয়। তাঁরা জানান, অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও ওস্তাদের কাছে সংগত করতে করতে তাঁরা পুরো পদ্মপুরাণ পুঁথিই মুখস্ত করে ফেলেছেন। তাঁরা এখন না দেখেই টানা কয়েক দিন কয়েক শ পৃষ্ঠার পদ্মপুরাণের লাচাড়ি আর পুঁথি অভিনয়সহ পরিবেশন করতে পারেন। প্রচলিত বাইশকবি, দ্বিজবংশী, মধুরবান্দাসহ বিভিন্ন পুঁথি আর ওস্তাদের পরম্পরায় পাওয়া নাম না জানা গীতিকারের রচনার সমন্বয়ে তাঁরা আলাদা একধরনের পদ্মপুরাণ রচনা করে এ গানের ভিন্ন আরেকটা পরিবেশনার ধারা তৈরি করে ফেলেছেন!
শান্তি আর প্রমিলা বলেন, হাওরাঞ্চলে প্রতি শ্রাবণ মাসে মনসাপূজার সময় সাধারণত যে বাইশকবি রচিত পদ্মপুরাণ নারী-পুরুষেরা বাড়ির উঠান কিংবা দাওয়ায় বসে পাঠ করেন, তাঁদের পরিবেশনা ঠিক সে রকম নয়। তাঁরা নেচে, গেয়ে অভিনয়সমেত পদ্মপুরাণের গান পরিবেশন করেন। এসব গানকে ‘ওঝার গান’, ‘বিষুরির গান’, ‘পদ্মপুরাণের গান’ এমন নানা নামে ডাকা হয়। আবার এমন পরিবেশনায় হিজড়াদের অংশগ্রহণ বেশি থাকে বলে অনেকে এসব পরিবেশনাকে ‘গুরমার (হিজড়ে) গান’ কিংবা ‘গুরমি গান’ও বলে থাকেন।
সুনামগঞ্জের কান্দিগাঁওয়ের যোগেশ সরকার পদ্মপুরাণের গানের জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। নয়ের দশকের মাঝামাঝি তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কাছেই গান শিখেছিলেন প্রমিলা রানী সরকার। এখন ৮ থেকে ১০ সদস্যের গানের দল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে তিনি ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা সম্মানী নিয়ে গান গাইতে যান। প্রমিলারও এখন অনেক নামডাক, শিষ্যও আছেন প্রচুর।
তাঁদেরই একজন পার্বতী মালাকার। ২৬ বছরের এ তরুণীর বাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার হরিপুর গ্রামে। ছয় মাস ধরে গান শিখছেন। তাঁর বাবা কিরণ মালাকারও (প্রয়াত) লোকগানের শিল্পী ছিলেন। তাঁর বাবার সংগ্রহে থাকা ৭৫ বছরের প্রাচীন পদ্মপুরাণের একটি পুঁথি উত্তরাধিকারসূত্রেই পার্বতী নিজের কাছে রেখেছেন। এ পুঁথি দেখে দেখে আর ওস্তাদের শেখানো গানের সমন্বয়ে তিনি পদ্মপুরাণের গান গেয়ে চলেছেন।
কথা বলা শেষে শান্তি-প্রমিলারা পদ্মপুরাণের গান পরিবেশন শুরু করেন। গানের তালে তালে দোহারের ভূমিকায় ‘ছড়’ (ঝেড়ে বিষ নামানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত একধরনের চামর) হাতে লখিন্দরের শরীর থেকে বিষ নামানোর অভিনয় করছিলেন পার্বতী। তখনই বিশেষভাবে চোখে পড়ে মধ্যবয়স্ক এক পাটুয়াজ-বাদককে। পরে জানা গেল, তাঁর নাম সনৎ দেবনাথ। তবে ‘সনৎ বাইন’ হিসেবেই সবাই তাঁকে চেনেন। তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতকের কপনা গ্রামে। ৪৫ বছর ধরে লোকবাদ্য বাজিয়ে আসছেন। কী অসাধারণ তাঁর বাদনপ্রতিভা!
সনৎ বাইনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে দ্বীপচরণ দাসের কথা, যাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লার সাউধেরশ্রী গ্রামে। মারা যান ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল। বেঁচে থাকলে ওই বছরের ৮ এপ্রিল চুয়াত্তর বছর পূর্ণ করতেন তিনি। হাওরাঞ্চলের প্রখ্যাত খোলবাদক ছিলেন। গানের আসরগুলোয় তাঁর খোলবাদন উন্মাদনা তৈরি করত। মালসি, কীর্তন, হোরিগান কিংবা ত্রিনাথের গানও গাইতেন তিনি।
দ্বীপচরণ দাসের গল্প হয়তো সবিস্তার আরেক দিন লেখা হবে। তবে হাওরের গ্রামে গ্রামে এত এত মরমি মহাজন, শিল্পী আর সাধকেরা আছেন, তাঁদের গল্প একজনমে কারও পক্ষেই বলে শেষ করা সম্ভব নয়। এই যে ফকিরি গানের কিংবদন্তিতুল্য সাধক সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মকদ্দস আলম উদাসী পঁচাত্তর বছর বয়সে মারা গেলেন ২০২২ সালের ১৪ জুলাই, তাঁর কথাই-বা জানেন কজন? ধামাইলগানের কিংবদন্তি গীতিকার রাধারমণের কেশবপুর গ্রামের মাঝপাড়ায় তাঁর বাড়ি, সে অর্থে রাধারমণের প্রতিবেশীও।
মকদ্দস আলম উদাসীর প্রয়াণের কিছুদিন আগে তাঁর ডেরায় যাওয়া হয়েছিল। গল্প, আড্ডা, গানে আমরা একটা বিকেল কাটিয়ে দিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় ফেরার আগে নিজের লেখা হাজারো বাউল-ফকিরি গানের মধ্যে উদাসী কণ্ঠে ধরলেন গান—‘এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা, মিছামিছি দুই দিনেরও পরবাস।’ তাঁর আগে থেকে খুঁড়ে রাখা ডেরালাগোয়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি এ গান গেয়েছিলেন। তাঁর পরনে ছিল সফেদ পাঞ্জাবি। এর কিছুদিন পরই তাঁর প্রয়াণ হলো। মকদ্দস আলম উদাসীর মতো হাওরাঞ্চলের এমন শত সহস্র সাধক-শিল্পীর গল্প বলা যাবে, যাঁরা আমাদের মরমি গানের ভুবন উজ্জ্বল করে আছেন। অথচ শহরের কজনই-বা তাঁদের চেনেন, জানেন?