একটি রাষ্ট্র যত কর্তৃত্ববাদী হয়, তত তার মুক্তচিন্তাকে ভয়। যাঁরা মানুষের চিন্তাকে জাগান, যাঁরা ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে সত্য বলতে তরুণদের সাহস জোগান, সেই মানুষগুলোকে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র বিপদ ভাববে, তাদের চোখে চোখে রাখবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তাঁদের চিন্তার সক্রিয়তার কারণে যখন মানুষ প্রতিবাদী হয়, গণরোষ দানা বাঁধে, তাদের নিষ্ক্রিয় করার নানা উপায় সেই রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা যে খুঁজতে থাকেন, সেটিও স্বাভাবিক। এটি পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যেমন হয়েছে, আজও হচ্ছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্ম থেকেই আমাদের সঙ্গে নব্য-উপনিবেশী আচরণ করেছে। তারা আমাদের পরিচিতি বদলে দিতে চেয়েছে, আমাদের ভাষাকে গুরুত্বহীন করে আরেকটি ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, আমাদের সংস্কৃতি এবং রাজনীতি তাদের শর্তে পরিচালিত করতে চেয়েছে। তাদের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান, জনমত সংগঠনের প্রয়াস চালান বুদ্ধিজীবীরা। দীর্ঘদিন বুদ্ধিজীবী বর্ণনাটি সমীহ উত্পাদন করত, কারণ এতে অন্তর্ভুক্ত করা হতো সেই সব মানুষকে, যাঁরা বুদ্ধির চর্চা করতেন এবং এই চর্চায় তাঁদের পেশার সীমা অতিক্রম করে সব মানুষের প্রয়োজনে, তাঁদের নানা পরিবর্তনকামী উদ্যোগে, সৃজনে-সংগ্রামে প্রাসঙ্গিক হতেন।
তাঁরা মানুষের কথাগুলো নিজেদের চিন্তায় ঠাঁই দিতেন, স্পষ্ট উচ্চারণে সেসব বলেও যেতেন। সেই ১৯৪৮ সালে সৈয়দ মুজতবা আলী মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ও বাঙালির অবিভাজ্যতার কথা লিখেছেন। ১৯৫২ সালে আমরা আমাদের মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠা দিলাম, ১৯৫৪ সালে রাজনীতিতে আমাদের অবস্থান সংহত করলাম। ১৯৬১ সালে বিরুদ্ধ পরিবেশে যখন রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালিত হলো, আমাদের সংস্কৃতির শক্তিটিও আমরা জানিয়ে দিলাম। আর ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ছয় দফার মুক্তিসনদ ঘোষণা করলেন, আমাদের মতো করে অর্থনীতিকে গড়ে তোলার অঙ্গীকারও ঘোষিত হলো। এই এতগুলো অমোঘ ঘোষণার মতো ঘটনার যোগফল আমাদের নিয়ে গেল সত্তরের নির্বাচনে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।
অর্থাৎ সেই ভাষা আন্দোলন থেকেই বুদ্ধিজীবীরা ভাষা নিয়ে লড়েছেন, সংস্কৃতির প্রকাশ স্পষ্ট করেছেন, রাজনীতির আদর্শগুলো বাঙ্ময় করেছেন, অর্থনীতির রূপরেখা তৈরি করেছেন। তাঁরা আমাদের পরিচিতি, সত্তা এবং সক্ষমতার ভিত্তিটি মজবুত করেছেন। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা তাদের সুরক্ষার জন্য নির্ভর করে সংগঠিত নানা শক্তি এবং বাহিনীর ওপর, যেমন পাকিস্তানিরা নির্ভর করত গোয়েন্দাদের ওপর। এই গোয়েন্দারা সব বুদ্ধিজীবীর খোঁজখবর রাখত। সারা বিশ্বেই সামরিক সরকারগুলো তাদের নাগরিকদের মাসের তিরিশ দিনই গোয়েন্দা দৃষ্টির নিচে রাখে, পাকিস্তানেও ছিল তা-ই। এ জন্য ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১, প্রতিটি বছর তারা অনেক বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের লেখালেখির জন্য কারাদণ্ড দিয়েছে। বহুবার জেলখাটা সরদার ফজলুল করিম বলতেন, সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করাটাকে পাকিস্তানিরা মানুষ খুন করার চেয়েও বড় অপরাধ বলে ভাবত। আর সমালোচনা যখন ক্ষমতার ভিত্তিকে দুর্বল করে ফেলত, তাদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্তও তারা নিত।
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবীকে পাকিস্তানিরা এবং তাদের আজ্ঞাবহ রাজাকার, আলবদর ইত্যাদি বাহিনী হত্যা করে, তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন বুদ্ধিজীবী। শহীদ হওয়া সেই জ্যোতির্ময় মানুষগুলো ছিলেন সত্যিকার অর্থেই বুদ্ধিজীবী। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, চিকিত্সক, সাংবাদিক, লেখক—অর্থাৎ যাঁরা স্বাধীনতার দিকে যাত্রার পথটি দীর্ঘদিন ধরে বেঁধে দেওয়ার কাজটি করে আসছিলেন।
যেসব বুদ্ধিজীবীকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে নৃশংসভাবে খুন করে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের একজন রাশীদুল হাসান, আমাকে শ্রেণিকক্ষে পড়িয়েছেন। আরেকজন মুনীর চৌধুরী, মাঝেমধ্যে ক্লাসে ঢুকে তাঁর কথা শুনতাম। রাশীদুল হাসান স্যার নম্রভাষী, সাহিত্যপ্রেমী মানুষ ছিলেন, কবিতা আর গান ভালোবাসতেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব আর আদর্শ তাঁকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল বুদ্ধিজীবী-হত্যার পরিকল্পনাকারী রাও ফরমান আলী এবং তাদের এ-দেশীয় স্তাবকদের কাছে।
অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব আমাকে স্নেহ করতেন প্রথম দিন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে যাওয়ার পর থেকেই। ডা. আলিম চৌধুরীকে জানতাম খ্যাতিমান একজন চক্ষুচিকিত্সক হিসেবে, যাঁর সংস্কৃতিমনস্কতার পরিচয় তাঁর রোগীরাও সহজে পেয়ে যেত।
একাত্তরজুড়েই এঁদের মতো বিবেকবান, স্বচ্ছ চিন্তা এবং মুক্ত মনের অধিকারী অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানিরা জানত, কামান-বন্দুকের যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দেখা যায়, তাদের পরাজিত করার কৌশল সাজানো যায়; কিন্তু কলম আর চিন্তার যুদ্ধে জয় তাদেরকেই পরাজয় মানতে হবে, যেহেতু এই যুদ্ধের সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি তারা কখনো ভাবতে পারেনি।
২.
বুদ্ধিজীবীরা যে বন্দুকের নিশানার নিচে থাকবেন, সে কথা তাঁরাও জানতেন। এ জন্য যুদ্ধের শুরুতেই অনেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন, কেউ কেউ যুদ্ধের মাঠেও ছিলেন। দেশে থাকা বুদ্ধিজীবীরা ঘন ঘন ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন। রাও ফরমান আলীর গোয়েন্দা আর রাজাকাররা তাঁদের অনেকের সন্ধান খুঁজে বের করেছে।
যাঁরা তাঁদের পরিণতি জেনেও থেকে গেছেন, তাঁরা যেন ভেবে নিয়েছিলেন যে তাঁদের আত্মদান ছাড়া এই দেশের ভিত্তি শক্ত হবে না। তাঁদের আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করব, তাঁদের জন্য শোক করব; কিন্তু তাঁদের জীবন আমরা উদ্যাপনও করব। এই উদ্যাপন শুভর, মঙ্গলের, আলোর। আর শুধু আজকের নয়, সারা বছরই যেন আমরা তা-ই করি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি আমাদের জীবনে আলো ছড়াবে, যেমন এই পঞ্চাশ-একান্ন বছর ধরে ছড়িয়ে যাচ্ছে।