১০ মাস আগে কক্সবাজারের চকরিয়ায় ছয় ভাইকে পিকআপ ভ্যানের চালক ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বিতীয়বার চাপা দিয়ে খুন করেছেন। চালক গাড়িটি পেছনে এনে আহত ব্যক্তিদের দ্বিতীয়বার চাপা না দিলে এত প্রাণহানি ঘটত না। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উঠে আসে।
পিকআপ ভ্যানের চালক সাহিদুল ইসলাম, মালিক মাহামুদুল করিম ও তাঁর ছেলে মো. তারেককে আসামি করে বুধবার চকরিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই। আসামিদের মধ্যে সাহিদুল কারাগারে। মাহামুদুল জামিনে আর তারেক পলাতক।
পিবিআই প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, চালক গাড়িটি দ্বিতীয়বার পেছন দিকে আহত ব্যক্তিদের ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে চালিয়ে পালিয়ে যান। দ্বিতীয়বার গাড়িটি পেছনে না চালালে এত প্রাণহানি ঘটত না। তাই তদন্তে এটিকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে মালুমঘাট এলাকায় (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে) পিকআপের চাপায় হাসিনাপাড়ার সুরেশ চন্দ্র সুশীলের পাঁচ ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীলের (২৯) মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত রক্তিম সুশীলকে (৩২) ভর্তি করা হয় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। ১৪ দিন পর সেখানে মারা যান রক্তিম সুশীল।
গুরুতর আহত হয়েছেন আরও এক ভাই প্লাবন সুশীল (২৫) ও বোন হীরা সুশীল (২৮)। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে প্লাবন সুশীল বাড়ি ফিরলেও মানসিকভাবে এখনো বিপর্যন্ত। ঘটনার পর থেকে চকরিয়ার মালুমঘাট খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসা নেন হীরা সুশীল। পিকআপের চাপায় তাঁর পা ও হাত ভেঙে গেছে।
এ ঘটনার ১০ দিন আগে ৩০ জানুয়ারি মারা যান তাঁদের বাবা সুরেশ সুশীল। ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে মালুমঘাটের একটি মন্দিরে বাবার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান মুন্নী সুশীল। ছয় ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় প্লাবন সুশীল বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় মামলা করেন। মামলাটিতে সাত দিন তদন্ত করে চকরিয়া হাইওয়ে পুলিশ। এরপর তদন্তভার পিবিআইয়ের হাতে ন্যস্ত করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই কক্সবাজারের পরিদর্শক এনামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পিকআপের মালিক মাহামুদুল করিম অনভিজ্ঞ ও লাইসেন্সবিহীন একজন চালকের হাতে গাড়িটি চালানোর জন্য তুলে দিয়েছেন, যা সড়ক পরিবহন আইনের পরিপন্থী। তা ছাড়া দুর্ঘটনার খবর শুনেও তিনি (মাহামুদুল) আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেননি। এ কারণে মাহামুদলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার সময় মো. তারেক পিকআপ ভ্যানে চালকের পাশে বসা ছিলেন। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার না করে উল্টো তিনি চালককে দ্রুত পালিয়ে যেতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ কারণে তাঁকেও আসামি করা হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, চালক সাহিদুল ইচ্ছাকৃতভাবে জেনেবুঝে গাড়িটি পেছনের দিকে চালিয়েছেন। ঠান্ডা মাথায় তিনি চালিয়েছেন। তাঁর উচিত ছিল প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া কিংবা পুলিশকে খবর দেওয়া। কিন্তু তা না করে আহত ব্যক্তিদের দ্বিতীয়বার চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়েছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় খুনের অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনের আরও চারটি ধারা দেওয়া হয় অভিযোগপত্রে।
ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া মুন্নী সুশীল বলেন, গুরুতর আহত ভাইবোনেরা যখন রাস্তায় পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, তখন চালক গাড়িটি পেছনের দিকে নিয়ে এসে আহত ভাইদের আবার চাপা দেন, যেন সবার মৃত্যু নিশ্চিত হয়। এরপর পিকআপ নিয়ে চালক কক্সবাজারের দিকে পালিয়ে যান। পিকআপ যখন প্রথম চাপা দেয়, তখন তিনি এক ভাইয়ের ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়েছিলেন। তাতে তিনি প্রাণে বাঁচেন।
মামলার বাদী প্লাবন সুশীল বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা বলে এসেছি, এটি হত্যাকাণ্ড। আমরা দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’ ছয় ছেলে হারিয়ে বিপর্যন্ত মা মৃণালিনী সুশীলের সবকিছু যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তাঁর একমাত্র চাওয়া—ছেলে হত্যার বিচার।