সেতু বিভাগের প্রকল্প
হাওরে এবার উড়ালসড়ক, ব্যয় ৬ হাজার কোটি টাকা
দিনে ২৬ হাজার যানবাহন চলবে বলে ধরে প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে, যা পদ্মা ও বঙ্গবন্ধু সেতুর চেয়েও বেশি।
কিশোরগঞ্জের হাওরে একটি উড়ালসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, যা জোগান দেওয়া হবে সরকারের কোষাগার থেকে।
উড়ালসড়ক নির্মাণের এই উদ্যোগ নিয়ে দুটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে—১. অর্থনীতির ওপর চাপ ও কৃচ্ছ্রসাধনের এই সময়ে বিপুল ব্যয়ে হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ কতটা যুক্তিযুক্ত। ২. উড়ালসড়কটি দিয়ে যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করবে বলে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত।
সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় এই উড়ালসড়ক নির্মিত হলে দৈনিক যে সংখ্যায় যানবাহন চলবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এখন পদ্মা সেতু ও যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করা যানের সংখ্যার চেয়ে বেশি।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উড়ালসড়কটি হবে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থেকে করিমগঞ্জের মরিচখালী পর্যন্ত ১৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার পথে। গত জুলাই মাসে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছে সেতু বিভাগ। প্রকল্পের আওতায় উড়ালসড়ক নির্মাণ ছাড়াও ১৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার বিদ্যমান সড়ক প্রশস্ত করা হবে।
প্রকল্প প্রস্তাবটি এখন সেতু মন্ত্রণালয়ে আছে। সেখান থেকে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। এটি বাস্তবায়ন করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২০ সালে চালু হওয়া ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের মধ্যে নির্মিত সারা বছর (অল ওয়েদার) চলাচলের উপযোগী সড়কের পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। কারণ, ৮৭৪ কোটি টাকায় নির্মিত ওই সড়ক হাওরের তিন উপজেলার সঙ্গে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের সংযোগ তৈরি করতে পারেনি। সড়কটির অপূর্ণতা দূর করতে এবার হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
এটা উদ্ভট হিসাব। এটি করা হয়েছে প্রকল্পটি জাস্টিফাই (যৌক্তিক দেখানো) করার জন্য।
উড়ালসড়ক প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামসহ এর আশপাশের এলাকার সঙ্গে কিশোরগঞ্জ সদরের সংযোগ তৈরি হবে, মিঠামইন উপজেলার সঙ্গে সেখানকার নির্মাণাধীন সেনানিবাস সরাসরি যুক্ত হবে। এর বাইরে নাকভাঙ্গা মোড় থেকে মরিচখালী বাজার পর্যন্ত বিদ্যমান সড়ক প্রশস্ত করা হবে। হাওরের বুকে সড়ক নির্মাণের ফলে পানিপ্রবাহ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এমন সমালোচনা থাকায় হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণে জোর দিচ্ছে সরকার।
কত যানবাহন চলবে
উড়ালসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দায়িত্ব দিয়েছিল সেতু বিভাগ। এ কাজে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বুয়েট সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য বলে জানিয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয়, প্রাথমিক নকশা প্রণয়নসহ আনুষঙ্গিক প্রাথমিক প্রস্তুতিমূলক কাজ করা হয়েছে।
সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় বলা হয়, উড়ালসড়ক দিয়ে ২০৩০ সালে প্রতিদিন ২৫ হাজার ৮০০ যানবাহন চলাচল করবে। সংখ্যাটি ২০৪৫ সালে প্রায় ৪৫ হাজারে দাঁড়াবে। দেশের অন্যতম ব্যস্ত মহাসড়ক ঢাকা-উত্তরবঙ্গ পথের বঙ্গবন্ধু সেতুতে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২১ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এই সেতুর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এবং খুলনা বিভাগের একাংশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে এখন দিনে গড়ে যানবাহন পারাপার হচ্ছে ১১ হাজারের মতো। এই সেতু সারা দেশের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলাকে যুক্ত করেছে।
অন্যদিকে হাওরের উড়ালসড়কটির পথে জাতীয় কোনো মহাসড়ক নেই। প্রস্তাবিত উড়ালসড়কটি হবে দুই লেনের। এই উড়ালসড়ক দিয়ে এত যানবাহন কীভাবে চলবে, এর কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য সেতু বিভাগের কাছে নেই।
উড়ালসড়ক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইকাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খান এম আমানত। উড়ালসড়ক দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২৬ হাজার যানবাহন চলাচল করার পূর্বাভাস কতটা যৌক্তিক, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাওরে আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প হবে, এটা ধরে নিয়ে এই পূর্বাভাস করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের একটা হাওর পরিকল্পনা আছে। এই উড়ালসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সুনামগঞ্জসহ আরও কিছু এলাকা থেকে সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে যানবাহন চলাচল বাড়বে। পর্যটকও বাড়বে।
হাওরের বিদ্যমান সড়কের মূল যানবাহন এখন ইজিবাইক, নছিমন ও করিমন। দূরদূরান্ত থেকে হাওর দেখতে যাওয়া কিছু মানুষ গাড়ি নিয়ে যান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরের উড়ালসড়ক দিয়ে পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু সেতুর চেয়ে বেশি যানবাহন চলবে—এ পূর্বাভাস অতিরঞ্জিত।
ব্যয় ‘উঠবে’ টোল থেকে
হাওরে উড়ালসড়ক প্রকল্পের সুফল হিসেবে পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কৃষিপণ্য পরিবহন সহজ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে উড়ালসড়কে তিনটি অবজারভেশন ডেক বা মঞ্চ রাখা হবে। পুরো প্রকল্পের জন্য ১৫১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
উড়ালসড়ক প্রকল্পটির ব্যয় ওঠানোর চিন্তা করা হচ্ছে টোল আদায় থেকে। এটি নির্মাণের পর টোল হার ঠিক করা হবে। কারণ হলো, সেতু বিভাগের অধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। নিজের আয়ে চলতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। হাওরের উড়ালসড়ক থেকে আয় কম হলে সরকারের কাছে ঋণী থাকতে হবে তাদের।
হাওরে উড়ালসড়ক প্রকল্পের বিনিয়োগ উঠে আসবে কি না, জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে তো প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য বলে দেখিয়েছে। সব উন্নয়ন তো সরকার লাভ করার জন্য করে না?’ তিনি বলেন, প্রকল্পটি এখনো পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ চলছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাই করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সঙ্গে একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তারা তৈরি করে দিয়েছে। আরও কিছু কাজ বাকি আছে।
প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ব্যয়ের যে হিসাব করা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সেতু বিভাগের অধীন বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটী থেকে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করা এবং দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প চলমান আছে। ওই প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা। আর প্রস্তাবিত উড়ালসড়ক প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৯ কোটি টাকা।
‘টোল কে দেবে, কেন দেবে’
উড়ালসড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচলের পূর্বাভাসটিকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন কি না, জানতে চাইলে বড় প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা উদ্ভট হিসাব। এটি করা হয়েছে প্রকল্পটি জাস্টিফাই (যৌক্তিক দেখানো) করার জন্য।’ তিনি আরও বলেন, হাওরে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করা দরকার, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে সেটা শুধু সড়ক বা উড়ালসড়কনির্ভর কেন, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক যোগাযোগব্যবস্থা তো নৌপথ।
টোল আদায় করে এই উড়ালসড়কের ব্যয় ওঠানো সম্ভব কি না, জানতে চাইলে ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, ‘টোল কে দেবে, কেন দেবে, ওখানে কি শিল্প আছে?’