চাইলেই কি নতুন ব্যবসা শুরু করা যায়? ব্যবসা শুরু করার জন্য শুধু পুঁজি বা মূলধন থাকলেই হবে না, মানতে হয় নির্দিষ্ট আইনকানুন। ব্যবসা ছোট বা বড় পরিসরে যেভাবেই হোক, নির্দিষ্ট নিয়ম না মেনে তা শুরু করা যায় না। ব্যবসা শুরু করতে জানতে হবে কোথায় কোথায় যেতে হবে, কী কী দলিল–দস্তাবেজ লাগবে, কীভাবে দলিল সম্পাদন করতে হবে। আবার ব্যবসার ধরন অনুযায়ী ভবিষ্যতে কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে, তা–ও শুরুতে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে।
স্থান নির্ধারণ
ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রথমেই ঠিক করতে হবে ব্যবসার পরিচালনা করার প্রতিষ্ঠান কোথায় হবে সেই স্থান। চাইলেই যেকোনো এলাকায় ব্যবসা শুরু করা যাবে না। আগে সিটি করপোরেশন থেকে জেনে নিতে হবে কোথায় ব্যবসা করতে পারবেন এবং কোথায় পারবেন না। যে স্থানে ব্যবসা পরিচালনা করতে ইচ্ছুক, সেটি কোন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের অধীন, শুরুতেই তা ভালোভাবে জেনে নেওয়া দরকার। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি কি প্রপ্রাইটরশিপ আকারে, না কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হবে, সেটাও নির্ধারণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে।
দলিলাদি সম্পাদন
ব্যবসার স্থানের জন্য প্রতিষ্ঠান ভাড়া নিতে হলে বাড়ির মালিকের সঙ্গে বাড়িভাড়ার লিখিত চুক্তি করতে হবে। ব্যবসাটি একা নাকি অংশীদারদের সঙ্গে করবেন, তা নির্দিষ্ট করতে হবে। যদি অংশীদারদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চান, তবে অংশীদারত্বের চুক্তি করতে হবে। এই চুক্তিতে ব্যবসার ধরন এবং অংশীদারদের কার কেমন অংশ থাকবে, তা নির্দিষ্ট করে লেখা থাকবে। অংশীদারি চুক্তি নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। কেউ যদি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করতে চান, তাহলে মূলধনের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। সাধারণত অন্যান্য যেকোনো চুক্তি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নোটারাইজড করে নিতে হয়। অংশীদারত্বের চুক্তি অন্যান্য চুক্তির মতো সম্পাদন করলে হবে না। অনেক সময় এ চুক্তি যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক (আরজেএসসি) অফিস থেকে নিবন্ধন করার প্রয়োজন হতে পারে।
নিবন্ধন করতে হবে
যেকোনো ব্যবসা ছোট হোক বা বড়, ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। সিটি করপোরেশন বা এখতিয়ারাধীন অফিস থেকে আবেদন ফরম নিয়ে যথাযথভাবে পূরণ করে জমা দিতে হবে। এর সঙ্গে নির্ধারিত কিছু ফি-ও জমা দিতে হয়ে। বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ অনেক এলাকাতেই অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স করা যাচ্ছে। ট্রেড লাইসেন্স করতে ফির পরিমাণ সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে জেনে নিতে হবে। আবেদনের সঙ্গে অফিসভাড়ার চুক্তিপত্র, অংশীদারি চুক্তির দলিলের কপি, ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি জমা দিতে হবে।
যদি কোনো কোম্পানি হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করতে চান, তাহলে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক (আরজেএসসি) অফিস থেকে নিবন্ধন করতে হবে এবং কোম্পানি হিসেবে সনদ নিতে হবে। এ অফিস কোম্পানি আইন ও অন্যান্য বিধি অনুসারে কোম্পানি, সমিতি ও অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দিয়ে থাকে। ব্যবসার ধরন বুঝে বিএসটিআই বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা থেকেও সনদের প্রয়োজন হতে পারে।
প্রতিষ্ঠানের নামে নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লাগতে পারে। বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ কোনো কোম্পানি বা ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) থেকে নিবন্ধনপত্র নিয়ে কোম্পানি করতে হবে। যদি বিদেশি কোনো নাগরিককে নিয়োগ করতে হয়, তাহলে এর জন্য একই অফিস থেকে ই–ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট (কাজের অনুমতি) নিতে হবে। যদি আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত কোনো ব্যবসা থাকে, তাহলে আলাদা আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত সনদ নিতে হবে।
ট্যাক্স–ভ্যাট নিবন্ধন
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আয়কর ও ভ্যাট প্রদানের জন্য টিন সার্টিফিকেট ও ভ্যাট সার্টিফিকেট নিতে হবে। এ সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পন্ন করা যায়। নির্ধারিত হারে প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর কর দেওয়া এবং ভ্যাট দেওয়া বাধ্যতামূলক।
প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পনি খোলার নিয়ম
যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক সংস্থায় (আরজেএসসি) নিবন্ধনের আগে কোম্পানির জন্য মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন এবং আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করতে হবে। মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশনে কোম্পানির উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি সম্পর্কে বলা থাকে। এতে ব্যবসার নাম, ধরন, লক্ষ্য, মূলধনের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখ থাকে। কীভাবে কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচিত হবে, কীভাবে কখন চুক্তি সম্পাদিত হবে, কীভাবে নতুন সদস্য নেওয়া হবে বা বাদ দেওয়া হবে, কোম্পানির সাধারণ সভা এবং বিশেষ সভা কীভাবে হবে, কীভাবে লভ্যাংশ বণ্টন করা হবে ইত্যাদি বিষয় আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে হবে।
কোম্পানির যে নামে রাখতে চান, সেটির নামে অন্য কোনো কোম্পানি রয়েছে কি না, তা যাচাই করা দরকার। বর্তমানে অনলাইনে তা যাচাই করা যায়। কোম্পানির নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলে সেখানে নামের ছাড়পত্র বিষয়টিও চলে আসবে এবং কোম্পানির নাম র্নিধারণ করা যায়। কোম্পানির নিবন্ধনের বিষয়টিও এখন অনলাইনে করা যায়। অনলাইনে আরজেএসসির নির্ধারিত ওয়েবসাইটে দেখানোমতে ফরম পূরণ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় দলিল সংযুক্তি করতে হবে। জমা দিতে হবে কোম্পানির ধরন ও মূলধনের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত ফিস। অনলাইনের পাশাপশি মূল কপি সরাসরিও জমা দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আবেদন করার পর নিবন্ধক যাচাই–বাচাই করে দেখবেন এবং আবেদনটি উপযুক্ত মনে করলে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কোম্পানির নামে সার্টিফিকেট দেবেন।
মেধাস্বত্ব নিবন্ধন
বর্তমানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম ও ধরন অনুযায়ী মেধাস্বত্ব নিবন্ধন করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম এবং লোগোর ওপর যেন মেধাস্বত্ব বজায় থাকে, তা জরুরি বিষয়। একই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে বা কাছাকাছি নামে অন্য কেউ ব্যবসা শুরু করতে পারে। এত ব্যবসার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় নিবন্ধন প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য পদ্ধতি সম্পন্ন করার পর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটির যে নামে রাখবেন, সে নামটির ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করে নেওয়া উচিত। চাইলে যে ইমেজটি সাইনবোর্ডে বা নামের সঙ্গে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন, সেটির কপিরাইট নিবন্ধন করা যায়। যদিও এ ট্রেডমার্ক বা কপিরাইট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়, তবে ব্যবসার স্বার্থে ট্রেডমার্কের নিবন্ধন করে নেওয়া উচিত। ট্রেডমার্কস নিবন্ধন করা থাকলে এ ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার পেতে সহজ হয়। পণ্য ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করা যায়। এ নিবন্ধনের জন্য ট্রেডমার্কস, ডিজাইন ও পেটেন্ট অধিদপ্তরে আবেদন করতে হয়। এ ছাড়া কোনো পণ্যের ডিজাইন এবং কোনো উদ্ভাবন যদি থাকে, তার পেটেন্টের জন্য আবেদন করার সুযোগ আছে। বর্তমানে অনলাইনে আবেদন করা যায়।
তানজিম আল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী