মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার: ‘চক্রে’ ঢুকে চার সংসদ সদস্যের ব্যবসা রমরমা
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে প্রথম আলো। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।
বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন ফেনী থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড।
লাইসেন্স নেওয়ার সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠায় তারা। অবশ্য ‘মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটে’ বা চক্রে যোগ দেওয়ার পর গত দেড় বছরে দেশটিতে প্রায় ৮ হাজার কর্মী গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির নামে। মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠানো এজেন্সির তালিকায় ৪ নম্বর স্থান পেয়েছে স্নিগ্ধা ওভারসিজ।
নিজাম হাজারীর মতো আরও দুজন সংসদ সদস্য এবং একজন সংসদ সদস্যের পরিবারের দুজন সদস্যের রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে মালয়েশিয়া চক্রে। সেগুলো হলো ফেনী-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল ও ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল। সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটালস ইন্টারন্যাশনাল। ১৯৭৯ সালে মুস্তফা কামাল অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠা করেন।
‘মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটে’ বা চক্রে যোগ দেওয়ার পর গত দেড় বছরে দেশটিতে প্রায় ৮ হাজার কর্মী গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির নামে। মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠানো এজেন্সির তালিকায় ৪ নম্বর স্থান পেয়েছে স্নিগ্ধা ওভারসিজ।
মালয়েশিয়া চক্র হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ দেওয়া হয় না। সুযোগটি পায় অল্পসংখ্যক এজেন্সি। শুরুতে চক্রের সদস্য ছিল ২৫টি এজেন্সি। পরে তিন ধাপে বেড়ে ১০০টি হয়েছে। চক্রে নাম ঢোকাতে প্রতিটি এজেন্সির কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে চক্রের হোতাদের বিরুদ্ধে। আর চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো বসে বসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে অন্তত দেড় লাখ টাকা ‘চক্র ফি’ পাচ্ছে। অবশ্য এ টাকার একটি অংশ চলে যায় মালয়েশিয়ার চক্র নিয়ন্ত্রকদের কাছে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশে এমন চক্র-ব্যবস্থা নেই।
প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের জুলাইয়ে যখন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে, তখন কর্মী পাঠানোর জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচনের দায়িত্ব পায় মালয়েশিয়া। তাদের কাছে ১ হাজার ৫২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠিয়েছিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু বেছে নেওয়া হয় মাত্র ২৫টিকে। এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নীতিমালা ছিল না। এ ক্ষেত্রে প্রভাব খাটানো ও ঘুষ লেনদেনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
এখন দেখা যাচ্ছে, তিন সংসদ সদস্য ও একজন সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এ খাতের নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে। আবার যাঁরা চক্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁরা ও তাঁদের স্বজনদের প্রতিষ্ঠানও চক্রে ঢুকে গেছে। কিন্তু অনেক পুরোনো প্রতিষ্ঠান জায়গা পায়নি।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশে এমন চক্র-ব্যবস্থা নেই।
ওদিকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ ঋণ করে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসছেন।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে গত ১৯ এপ্রিল জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে এক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই দুর্বিষহ, মানবেতর ও অমর্যাদাকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। চাকরির ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
এমন পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়া আপাতত বিদেশি কর্মী নেওয়া স্থগিত করেছে। ইতিমধ্যে যাঁরা মালয়েশিয়া যাওয়ার ভিসা পেয়েছেন, অনুমোদন পেয়েছেন, তাঁদের আগামীকাল শুক্রবারের মধ্যে দেশটিতে প্রবেশ করতে হবে।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই দুর্বিষহ, মানবেতর ও অমর্যাদাকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। চাকরির ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
সংসদ সদস্যের প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) গত দেড় বছরে মালয়েশিয়া যেতে প্রায় সাড়ে চার লাখ কর্মীর ছাড়পত্র দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মালয়েশিয়ায় এককভাবে শ্রমিক পাঠানোর শীর্ষে রয়েছে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বায়রার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী।
ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। বিএমইটি বলছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মতো কর্মী পাঠিয়েছে। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে এই এজেন্সি একাই ছাড়পত্র নিয়েছে ৮ হাজার ৫৯২ কর্মীর।
মাসুদউদ্দিন চৌধুরী ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে ফেনী-৩ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য হন। যদিও তিনি প্রথমে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। রাজনীতিতে আলোচনা আছে যে আওয়ামী লীগের পরামর্শেই তিনি জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করেন।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর দিক দিয়ে পঞ্চম অবস্থান রয়েছে ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খোলার আগে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। বিদেশে পাঠিয়েছিল মাত্র ২৩৮ কর্মী। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে তারা শীর্ষ তালিকায় চলে যায়। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ কর্মী। চক্র গঠনের সময় বেনজীর ছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি।
বিভিন্ন এজেন্সি তাঁদের মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়েছে। তবে সরকার-নির্ধারিত খরচের বাইরে তাঁরা কোনো বাড়তি টাকা নেননি।বায়রার নির্বাহী পরিচালক শাহেলা পারভীন
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের নামে মালয়েশিয়ায় গেছেন মোট ৯ হাজার ৮৬১ জন। চক্র গঠনের সময় আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
মালয়েশিয়া চক্রে নাম থাকার বিষয়ে বক্তব্য জানতে তিন সংসদ সদস্য ও এক সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। বায়রার ওয়েবসাইটে দেওয়া স্নিগ্ধা ওভারসিজের ফোন নম্বরে কল দিলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক শাহেলা পারভীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন এজেন্সি তাঁদের মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়েছে। তবে সরকার-নির্ধারিত খরচের বাইরে তাঁরা কোনো বাড়তি টাকা নেননি।
অবশ্য চক্রে না থাকা তিনটি এজেন্সির মালিকেরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কর্মীর চাহিদা পেয়ে চক্রকে ফি দিয়ে তাঁদের নামে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠিয়েছেন। প্রতি কর্মীর জন্য ১ লাখ ৫২ হাজার থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে চক্রে থাকা এজেন্সিকে।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঐশী ইন্টারন্যাশনাল এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এই দুটি প্রতিষ্ঠান চক্রের সক্রিয় সদস্য।
বিরোধিতা করে নিজেরাই চক্রে
বায়রার সদস্যদের অভিযোগ, এবার চক্র তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন ওরফে স্বপন। চক্রের ১০০টি এজেন্সির মধ্যে ৬৯টির নাম তিনি ঠিক করেছেন। তাঁর মাধ্যমেই টাকা লেনদেন হয়েছে মালয়েশিয়ায়। বিএমইটির হিসাবে দেখা যায়, স্বপনের এজেন্সি ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের নামে মালয়েশিয়ায় ৭ হাজার ১০২ শ্রমিক গেছেন। এ বিষয়ে রুহুল আমিনের বক্তব্য জানতে নানাভাবে চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো চক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ২০২২ সালে বায়রার নির্বাচনে জয় পায় মোহাম্মদ নূর আলী-মোহাম্মদ আবুল বাশার সমর্থিত প্যানেল। সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশারের এজেন্সি নেই চক্রে। তবে তাঁর ছেলে ইশতিয়াক আহমেদের এজেন্সি বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড ও জামাতা গোলাম রাকিবের নতুন এজেন্সি পিআর ওভারসিজ নাম লিখিয়েছে চক্রে।
পিআর ওভারসিজ ২০২১ সালের অক্টোবরে লাইসেন্স নেয়। চার হাজারের বেশি কর্মী পাঠিয়েছে তারা।
বায়রার সভাপতি আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য ছেলে ও জামাতার এজেন্সিকে টাকার বিনিময়ে তালিকায় নাম দিয়েছে চক্র। বিরোধীরা পরে চক্রে যোগ না দিলে এবার মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা যেত।
আবুল বাশারের ছেলে ইশতিয়াক আহমদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তালিকায় নাম দিতে কোনো টাকার লেনদেন হয়নি। অন্যদিকে আবুল বাশারের জামাতা গোলাম রাকিব টাকা দেওয়ার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে ফোন কেটে দেন।
এদিকে বায়রার শেষ নির্বাচনে জিতে সংগঠনটির মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছিলেন শামীম আহমেদ চৌধুরী। যদিও পরে তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের আগেই তাঁর এজেন্সি সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল ঢুকে যায় চক্রে।
নতুন আরও কিছু প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে বিপুল কর্মী পাঠিয়েছে। ২০২১ সালের মার্চে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেয় ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ। ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৩৪৪ জন কর্মী পাঠিয়েছিল তারা। তবে মালয়েশিয়ার চক্রে ঢুকে দেড় বছরে কর্মী পাঠিয়েছে ৭ হাজারের বেশি।
চক্রে ঢুকেই ব্যবসা রমরমা
আগে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও এবার চক্রে ঢুকে কর্মী পাঠানো শীর্ষ এজেন্সির তালিকায় চলে এসেছে ঢাকা উত্তর সিটির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের (ভাটারা এলাকা) কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলামের এজেন্সি বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড। ৭ হাজার ২২৫টি ছাড়পত্র নিয়েছে তাঁর এজেন্সি।
বায়রার একাধিক সদস্যের দাবি, চক্র তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া রুহুল আমিনের সঙ্গে সখ্য আছে কাউন্সিলর শফিকুলের। তাঁর বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে কল করা হয়। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
২০২২ সালের জুলাইয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নিয়ে চক্রে নাম লেখান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ। তাঁর প্রতিষ্ঠান অনন্য অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সি ২ হাজার ৬০০ কর্মীর ছাড়পত্র নিয়েছে। মুঠোফোনে ৪ মে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা নিয়ে সামনে বসে কথা বলতে হবে। অবশ্য দেখা করার জন্য একাধিকবার ফোন করলেও তিনি আর ধরেননি।
নতুন আরও কিছু প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে বিপুল কর্মী পাঠিয়েছে। ২০২১ সালের মার্চে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেয় ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ। ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৩৪৪ জন কর্মী পাঠিয়েছিল তারা। তবে মালয়েশিয়ার চক্রে ঢুকে দেড় বছরে কর্মী পাঠিয়েছে ৭ হাজারের বেশি।
চক্র ফি দিয়ে ইম্পেরিয়ালের মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়েছেন বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে দুটি এজেন্সি। এ নিয়ে কথা বলতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি সব শুনে এক ঘণ্টা পরে ফোন করতে বলেন। এরপর আর ফোন ধরেননি।
নিজের অটোরিকশা ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে, মানুষের কাছে ঋণ করে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম। এখন আমি নিঃস্ব, ঋণগ্রস্ত।নারায়ণগঞ্জের মো. সেলিম
২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার-নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা। যদিও নেওয়া হয় অনেক বেশি।
২০২৩ সালের মে থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ৩৫৭ জন মালয়েশিয়াপ্রবাসীর সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি জরিপ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ভেরিটে ইনকরপোরেটেডসহ পাঁচটি সংস্থা। এতে বলা হয়, মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। ৯৬ শতাংশ কর্মীকে অন্তত একটি উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের মো. সেলিম গত বছর মার্চে মালয়েশিয়ায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রতিশ্রুত কাজ পাননি। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে তাঁকে পাইলিংয়ের কাজ দেওয়া হয়। পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান তিনি। কোনো চিকিৎসা করায়নি কোম্পানি। প্রায় দেড় মাস অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থেকে তিনি বাধ্য হয়ে নিজের টাকায় টিকিট কেটে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে আসেন।
সেলিম বলেন, ‘নিজের অটোরিকশা ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে, মানুষের কাছে ঋণ করে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম। এখন আমি নিঃস্ব, ঋণগ্রস্ত।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেড় বছরে সাড়ে ৪ লাখের মতো লোক পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফি-এর চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা করে চক্র ফি নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী ১১ মে প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য নির্দিষ্ট এজেন্সির তালিকা নির্ধারণ করেছে মালয়েশিয়া। কর্মী পাঠানো নিয়ে যেসব অভিযোগ আসছে, এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অবশ্য বারবার চক্র গঠন ও শ্রমিকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠলেও কখনোই ব্যবসা নেয়নি মন্ত্রণালয়। বরং ২০২২ সালেও চক্র গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিকেরা বেকার
মালয়েশিয়ায় গিয়ে বেকার থাকছেন শ্রমিকদের অনেকে। সেটা সরকারও স্বীকার করে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, পাঁচ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ পাননি। তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
অবশ্য মালয়েশিয়ায় বহু বছর ধরে থাকা বাংলাদেশিদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার। কেউ কেউ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পণ্য বিক্রি করে খাবার খরচ জোগানোর চেষ্টা করেন। কেউ কেউ বৃষ্টি হলে দোকান থেকে ছাতা কিনে রাস্তায় বিক্রি করেন। কেউ ছোটখাটো কাজ করে কোনোরকমে টিকে আছেন।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য নির্দিষ্ট এজেন্সির তালিকা নির্ধারণ করেছে মালয়েশিয়া। কর্মী পাঠানো নিয়ে যেসব অভিযোগ আসছে, এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী
এদিকে গত জানুয়ারি থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে সহায়সম্বলহীনভাবে খালি হাতে ফিরেছেন ৪৫৩ কর্মী। তাঁদের পাসপোর্টও ছিল না। ভ্রমণের অনুমতি নিয়ে তাঁরা ফিরে এসেছেন।
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকেরা যে দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে পড়বেন, সে আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরও সেটা জানত। তারপরও চক্রের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে রাজি হওয়া উচিত হয়নি।