আমাদের রক্তের ঋণ এখনো শোধ হয়নি
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় মুক্তি আমরা পেয়েছি, তা আমাদের বহু কিছু দিয়েছে। দিয়েছে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, তা সে সিদ্ধান্ত ভুল বা সঠিক যা–ই হোক না কেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্রিটেন আর তারপর পাকিস্তানের মতো শাসকদের কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের জনগোষ্ঠী তার প্রতিটি অংশে নিজস্ব উদ্যোগের স্পৃহা সঞ্চার করতে পেরেছে। এ কারণে আমাদের অর্থনীতির ওপর থেকে ব্রিটিশ এবং অবাঙালি ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীদের আধিপত্য হটে গিয়েছে। এই অর্থপূর্ণ পরিবর্তন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ষুদ্র কৃষক, নারী–কর্মী, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা, অভিবাসী শ্রমিক, পোশাক রপ্তানিকারক, প্রযুক্তি উদ্যোক্তা বা বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা প্রভৃতির মধ্যে উদ্যোগী গতিশীলতা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এসবের মধ্যে কিছু নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও এর ফলে আমরা ভিক্ষার ঝুলি ফেলে দিয়ে উন্নীত হয়েছি একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতিতে।
আমাদের অর্থনীতি নানাভাবে অনেক বেশি বহুমুখী ও বিকশিত হয়েছে, রপ্তানি বেড়েছে এবং আমাদের অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে উন্নতি হয়েছে। এসব অর্জনের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রমাণ হলো পদ্মা সেতু। একই সঙ্গে আমাদের দারিদ্র্য কমেছে, শিক্ষা ও চিকিৎসার বিস্তৃতি বেড়েছে।
তবে যা এখনো সত্যি হয়নি তা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুরোপুরি সম্মান দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে জীবিত রাখা। আমাদের গণতান্ত্রিক পথযাত্রা বারবার ব্যাহত হয়েছে এবং কখনো কখনো উল্টো পথে চলছে। অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর তুলনায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি ভালোভাবে বজায় রাখলেও আমাদের দেশের সংখ্যালঘু মানুষের মনে এখনো আমরা সমতার অনুভূতি নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রমাণ দিয়েছি—এখন আমরা আর বিদেশি অনুদান অথবা পরামর্শের মুখাপেক্ষী নই। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি থেকে আমরা বহু দূরে সরে এসেছি। ধনবানেরা এ দেশের অর্থনীতিকে গ্রাস করে নিয়েছে এবং রাজনীতি এখন ক্ষমতা ও টাকার জিম্মায় চলে গেছে। রাষ্ট্রের পরাক্রমশালী ক্ষমতার সামনে এসব অবিচারের বিরুদ্ধে কিছু বলা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার বিষয়ে আমাদের আদালতগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মূল ভাবনা ছিল বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া; আর এ দেশের জনতার, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতায়ন—যাতে তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়পরায়তার প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেদের পুরো সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পায়। অর্ধশতক পার হয়ে গেছে, অথচ একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজ নিয়ে আমাদের ভাবনাগুলো উপেক্ষিতই থেকে গেল।
যে জনতা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং নিজের জীবন ও বিষয়সম্পত্তি হারিয়ে সবচেয়ে বড় মূল্য দিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমাদের রক্তের ঋণ আছে। ক্ষমতাবানেরা যেভাবে ক্ষমতা ও সম্পদ আত্মসাৎ করছে, তাতে বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক ব্যবধান আর সামাজিক বৈষম্য ইঙ্গিত দেয় যে আমাদের সে রক্তের ঋণ এখনো শোধ হয়নি।
আরও অনেকের মতো আমার নিজের জীবনে মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক সন্ধিক্ষণ। বাংলাদেশের জন্য বিদেশে ৯ মাস প্রচারণার কাজ চালানোর পর ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর যখন ঢাকার বিমানবন্দরে নামলাম, তখন এমন এক পরিপূর্ণতার অনুভূতি হয়েছিল যে সেটি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারা আমাকে একটি গৌরব ও আত্মমর্যাদার বোধ দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমাদের এমন স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে যে আমরা সেই ন্যায়পরায়ণ সমাজটি গড়ে তুলতে পারব, যার জন্য একদিন যুদ্ধ করেছি এবং বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন।
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ, জনবুদ্ধিজীবী এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা