স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিবেশ থাকা দরকার: মতিউর রহমান
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় অনেক সংস্কারের কাজ করতে হবে। আর রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সফল হতে হলে সমাজের সর্বত্র উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিবেশ থাকা দরকার। সব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়ে আরও খোলামেলা আলোচনা হতে হবে। স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সাহসের সঙ্গে সাংবাদিকতার কাজ করে যেতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক সিতারা পারভীনের নামে চালু করা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে প্রথম আলো সম্পাদক এ কথা বলেন।
আজ মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিএসএস (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম থেকে দশম স্থান অর্জনকারী ১০ জন কৃতী শিক্ষার্থীকে পুরস্কার হিসেবে সনদ ও অর্থ তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান। এ সময় তিনি অধ্যাপক সিতারা পারভীনকে স্মরণ করে বলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য মাটির নিচে। কিন্তু মাটির ওপরে কতটুকু রেখে গেলাম, মাটির নিচে চলে যাওয়ার পর কতজন মানুষ আমাদের স্মরণ করছেন, সেটি যেকোনো ব্যক্তির জীবনে বড় পাওয়া।’
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র নিয়ে প্রথম আলো সম্পাদকের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে উপাচার্য বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র মানুষের দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা।
‘সাংবাদিকতাই প্রথম আলোর একমাত্র কাজ’
ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বক্তব্য দেন প্রথম আলো সম্পাদক। ৬২ বছরের নানা ঘটনা ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বিগত স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের আমলে সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যম নিয়ে যা চলছিল, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। সে রকম ব্যবস্থা আর চলতে পারে না। সে জন্য বারবার মনে পড়ে যায়, সেই ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট আর মিছিলের কথা। সেদিন আমাদের স্লোগান ছিল—কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, গণতন্ত্র চাই, নির্বাচন চাই।’ তিনি বলেন, এখনো সেই দাবিই করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন সরকারের সময়ে প্রথম আলোর ওপর নানা রকমের চাপ, ভয়ভীতি, বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া, মামলা ও বাধার কথা উল্লেখ করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তা এখনো বন্ধ হয়নি। কিন্তু প্রথম আলোর বিরুদ্ধে করা অভিযোগের কোনো সত্যতা বা ভিত্তি নেই। আগেও ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। সাংবাদিকতাই প্রথম আলোর একমাত্র কাজ।
একতা থেকে ভোরের কাগজ এবং ১৯৯৮ সালের নভেম্বর থেকে প্রথম আলো প্রকাশের কথা তুলে ধরেন মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ২০০০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও ২০০১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি সরকারের আমলে প্রথম আলোতে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গোয়েন্দা সংস্থার সমর্থনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একটি গোষ্ঠী প্রথম আলো পত্রিকা বিক্রিতে বাধা দিয়েছিল। একটি মহল তখন প্রথম আলো বন্ধ ও সম্পাদককে গ্রেপ্তার করার নানা রকম চেষ্টা চালিয়েছিল। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল এক শর ওপরে। এখন ২৫টি মামলা কার্যকর রয়েছে। ২০১৫ সালে প্রায় ৫০টি দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে মৌখিক নির্দেশ দিয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়। এর আগে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়।
প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, প্রথম আলোর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার এতটাই বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু।’
‘মানুষ আশাবাদী হতে চায়’
প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, জুলাই-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন হয়েছে। প্রায় চার মাস হতে চলেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কথা ও কাজগুলো ফলপ্রসূ হোক, সেটা মানুষ দেখতে চায়, মানুষ আশাবাদী হতে চায়। এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে মত ও সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োজন। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বা উপদেষ্টারা সজাগ আছেন বলে তিনি মনে করেন।
প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, ‘আমরা দেখছি, কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচারণা চালাচ্ছেন। সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন। এই সব কিছুই দেশের স্বাধীন সংবাদপত্রের কাজে ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বড় বাধা।...এতে সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছুর সম্ভাবনা নেই।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপারসন ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিতারা পারভীন ট্রাস্টের পক্ষে অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী ও পুরস্কার পাওয়া শিক্ষার্থীদের একজন ফারাহ জাহান বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল হক এবং অধ্যাপক সিতারা পারভীনের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করে শিক্ষক আমিনা খাতুন।
এবার অধ্যাপক সিতারা পারভীন পুরস্কার পেয়েছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারাহ জাহান, উসামা রাফিদ, তাহসীন নওয়ার, মো. রাফিজ খান, হোসাইন আজমল, মেহেদী হাসান, মো. তানজীর হোসাইন, নিগার সুলতানা, মেহনাজ লামিসা রহমান ও নাহিদা সুলতানা।