চার পাহাড়ি হত্যায় দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবি ৪৪ বিশিষ্টজনের
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চার পাহাড়ি ব্যক্তিকে হত্যা; তাঁদের বাড়িঘরে আগুন, লুটের ঘটনার নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি করেছেন ৪৪ বিশিষ্টজন। তাঁরা এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের পানখাইয়া পাড়ায় এবং মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক যুবক মোটরসাইকেল চুরি করার অভিযোগে গণপিটুনির শিকার হন এবং পরে হাসপাতালে মারা যান। নিহত মামুনের স্ত্রী থানায় যে মামলা করেছেন, তাতেই সুস্পষ্টভাবে হত্যার জন্য দায়ী তিনজন সেটেলার বাঙালির নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাতনামা অনেকের বিরুদ্ধে এই হত্যার অভিযোগ করেছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মামুনের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর অভিবাসী বাঙালি এবং স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় পাহাড়িদের ৩৭টি ঘরবাড়ি ও দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অভিযোগ, নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার বদলে পাহাড়িদের ওপর হামলায় লিপ্ত ব্যক্তিদের নানাভাবে উৎসাহ ও মদদ জুগিয়েছেন। গুলিতে জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল ত্রিপুরা (২০) নিহত হন।
বিবৃতি উল্লেখ করা হয়, খাগড়াছড়ির ঘটনার জের ধরে গত ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালিদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ডিসি অফিসের ২০০ গজের মধ্যে একটি চায়ের দোকানে বসে থাকা অনিক চাকমাকে (১৯) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ভিডিও ফুটেজে হত্যাকারীদের স্পষ্ট চেহারা এবং পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঘটনার সময় ভাঙচুর চালানো হয়েছে বনরূপা মৈত্রী বিহারে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিস। এ ঘটনায় কাউকে অভিযুক্ত বা গ্রেপ্তার এখনো করা হয়নি।
বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘২১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি সফর করেন। তাঁরা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সেনানিবাসে বসে বাঙালি এবং জাতিগত নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে ভুক্তভোগীদের মতামত শোনেননি বা তাঁদের কোনো সান্ত্বনা দেননি। আদিবাসী নাগরিক সমাজের কতিপয় ব্যক্তি একটি মতবিনিময় সভায় ছিলেন বলে জেনেছি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ যেমনভাবে হতাশ ও মর্মাহত হয়েছিল, আমরাও দারুণভাবে বিস্মিত। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবশ্য কঠোর ভাষায় বলেছেন, এ ঘটনায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের অনেককে স্পষ্ট শনাক্ত করা গেছে, তাঁদের কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি।
‘আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি, দশকের পর দশক পার্বত্য তিন জেলাসহ অন্যান্য জেলার আদিবাসী মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে এবং স্বাধীনতা–পরবর্তী দশকের পর দশক ধরে যে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন। মৌলিক নিরাপত্তা ও মানবিক আচরণের ক্ষেত্রেও একই ধরনের রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও অবহেলার মধ্যে দিনাতিপাত করেন। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও বারবার তাঁদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিহীন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত সাফল্যের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।’
বিবৃতিতে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে আছে খাগড়াছড়িত ও রাঙামাটিতে ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর ৪ জনকে হত্যাসহ সকল ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করা। ভিডিও ফুটেজে চিহ্নিত দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
নিহত চার পাহাড়ির পরিবারের সদস্যদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবিও করা হয়। এর পাশাপাশি যাঁদের বাড়িঘর লুটপাট করা হয়েছে এবং দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদেরও যথাপোযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি করা হয়।
পাহাড়ে শান্তি ও সমঝোতার পরিবেশ বজায় রাখতে অপ্রকাশ্যে পাহাড়িবিরোধী কোনো বহিরাগত জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় কোনো এজেন্সি বা মহল থেকে মদদ বা সহায়তা দেওয়া অবিলম্বে বন্ধের দাবি করা হয় বিবৃতিতে।
বিবৃতিদাতারা বলেন, সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে একটি সময় নির্দিষ্ট করে রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। যেটি বৈষম্যমুক্ত ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন বাস্তবায়নে অপরিহার্য।
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, লুট, অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অবিলম্বে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সব অংশীজন এবং দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের উচ্চ প্রতিনিধিদের নিয়ে গোলটেবিল আলোচনার আয়োজনের দাবিও করা হয়। সেই আলোচনার সুপারিশের ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন বিশিষ্টজনেরা।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন সুলতানা কামাল, খুশি কবীর, জেড আই খান পান্না, ইফতেখারুজ্জামান, পারভীন হাসান, ফেরদৌস আজিম, তবারক হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, সারা হোসেন, শিরিন পারভীন হক, সামিনা লুৎফা, শহিদুল আলম, সুমাইয়া খায়ের, তাসলিমা ইসলাম, রেহনুমা আহমেদ, শাহনাজ হুদা, রোবায়েত ফেরদৌস, খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, জোবায়দা নাসরিন, শামসুল হুদা, সালমা আলী, গীতি আরা নাসরীন, সাদাফ নুর, মির্জা তাসলিম সুলতানা, মিনহাজুল হক চৌধুরী, রোজিনা বেগম, মাইদুল ইসলাম, স্বপন আদনান, পল্লব চাকমা, মণীন্দ্র কুমার নাথ, রেজাউল করিম চৌধুরী, ফস্টিনা পেরেইরা, নোভা আহমেদ, ফারহা তানজীম তিতিল, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, জাকির হোসেন, সাইদুর রহমান, আশরাফ আলী, শাহদাত আলম, নাজমুল হুদা, মো. আজিজুল্লাহ ইমন, দীপায়ন খীসা, হানা শামস আহমেদ ও মুক্তাশ্রী চাকমা।