সচিবালয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পেছনে যত কারণ
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত হয় বৈদ্যুতিক স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ) থেকে। সাধারণত সকেট-প্লাগে লুজ কানেকশন (দুর্বল সংযোগ), কেব্লে ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ ইত্যাদি কারণে বৈদ্যুতিক স্পার্ক হয়ে থাকে। এই ঘটনায় কোনো বিস্ফোরকের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়নি।
অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনার কারণ বের করতে গঠিত কমিটির প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটি আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন তুলে দিয়েছে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগুনের উৎপত্তিস্থল ৭ নম্বর ভবনের ৬ তলার লিফট লবিসংলগ্ন করিডর থেকে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। পরে সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণে এর সত্যতা পাওয়া যায়। আগুনের সূত্রপাত ২৬ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১টা ৩০ মিনিট থেকে ১টা ৪০ মিনিটের মধ্যে। অগ্নিনির্বাপণ কর্মীদের সাক্ষ্য ও উত্তর দিক থেকে নেওয়া ভিডিও বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, আনুমানিক রাত ২টায় আগুন ডেভেলপ স্টেজে (বিকশিত স্তর) চলে যায়। ভবনে কোনো ধরনের ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম না থাকায় প্রাথমিক ও বিকশিত অবস্থায় আগুন শনাক্ত করা যায়নি বলে তদন্ত কমিটি জানিয়েছে।
বুয়েটের পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞ দলের পর্যবেক্ষণের কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, টানেলসদৃশ করিডরের ফলস সিলিং দাহ্য ও অতি দাহ্য পদার্থ দিয়ে আচ্ছাদিত থাকায় আগুন অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের লিফট ও সিঁড়ির অপরিকল্পিত নকশার কারণে চিমনি এফেক্ট সৃষ্টি হয়, যাতে আগুনের শিখা দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী প্রপাগেশন করে ৬ তলা থেকে ৭, ৮ ও ৯ তলায় ছড়িয়ে যায়, যা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। করিডরে আগুন প্রবাহকালে পাশের কক্ষগুলোর দরজা পুড়ে যায়। কক্ষের ভেতরে দাহ্যবস্তু (কাগজ, কাপড়, ফোম, কার্পেট, ফার্নিচার ইত্যাদি) রক্ষিত থাকার কারণে কক্ষে আগুন প্রবেশ করে। বিভিন্ন কক্ষে ফুয়েলের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে বিভিন্ন কক্ষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬ তলার ৫২৪ নম্বর এবং ৮ তলার ৭০৪ নম্বর কক্ষ দুটির এয়ারকন্ডিশন থেকে রেফ্রিজারেন্ট নির্গত হয়ে প্রজ্বালনের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দলের পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দলের পর্যবেক্ষণও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। কোনো ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে নাশকতামূলকভাবে আগুনের সূত্রপাত ও বিস্তার করা হয়েছে কি না, তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। আগুনের ক্ষয়ক্ষতি ও মাত্রা বিবেচনায় বিশেষজ্ঞ দল প্রাথমিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের তিনটি সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাউন্টার আইইডি ফিউশন সেন্টারের পরীক্ষাগারে প্রাথমিকভাবে শণাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষায় কোনো বিস্ফোরকের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়নি। সংগ্রহ করা একটি নমুনা বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা করে কোনো রকম ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডগ স্কোয়াড মোতায়েন করে কোনো ধরনের বিস্ফোরকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের পর্যবেক্ষণ
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণের তথ্যও তুলে ধরা হয় প্রাথমিক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ফায়ার সার্ভিসের প্রথম তিনটি দল ৭ নম্বর ভবনের পশ্চিম অংশের ষষ্ঠ তলার সিঁড়িতে ১টা ৫২ ঘটিকায়, মাঝের সিঁড়িতে ১টা ৫৮ ঘটিকায় এবং পূর্বাংশের সিঁড়িতে ২টা ৭ ঘটিকায় ফায়ারফাইটিং শুরু করে। ফায়ারফাইটারদের ভাষ্যমতে, এই সময়ে আগুন ষষ্ঠ তলার করিডরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিকশিত পর্যায়ে ছিল।
অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার অপারেশন পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাব ও বিশেষ গাড়ি (উঁচু মই সংযুক্ত ফায়ার গাড়ি) প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা থাকায় গতানুগতিক ফায়ারফাইটিং করা হয়েছিল। পরে শুধু দুটি বিশেষ গাড়ি (উঁচু মই সংযুক্ত গাড়ি) ৭ নম্বর ভবনের দক্ষিণ দিকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। প্রতিটি তলায় করিডরে ৪টি কলাপসিবল গেট তালা দিয়ে আটকানো ছিল এবং সেখানে প্রচণ্ড ধোঁয়া ও তাপ সৃষ্টির ফলে তালা কেটে ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হয়েছে।
প্রতিটি তলায় সৌন্দর্যবর্ধন (ইন্টেরিওর ডিজাইন) অতিমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়, যা উচ্চ মাত্রার দাহ্যবস্তু এবং আগুন বিস্তারে অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্রতি তলায় অধিকাংশ কক্ষে উচ্চ ও সহজ দাহ্যবস্তু দিয়ে কক্ষগুলো বিভাজন করা ছিল। প্রতিটা ফলস সিলিংয়ের ওপরে বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক তারসহ অন্যান্য তার ছিল। কোনো কোনো কক্ষের পরিমাপ অনুপাতে অপেক্ষাকৃত বেশি ইন্টেরিওর ডেকোরেশন, কাগজপত্র ও আসবাব ছিল।
৭ নম্বর ভবনটিতে এলার্ম অ্যান্ড ডিটেক্টর সিস্টেম, কন্ট্রোল প্যানেল, অটো স্প্রিংকলার ইত্যাদি অগ্নিনিরাপত্তার সিস্টেম ছিল না। কোনো কোনো তলায় হোজপাইপ সিস্টেম থাকলেও তা ছিল অকার্যকর ও নজেলবিহীন। ফলে ম্যানুয়ালি লাইন খুলে প্রতিটি ফ্লোরে ফায়ার সর্ভিসের হোজপাইপ লে-আউট করে পানি সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছিল সময়সাপেক্ষ।
সচিবালয়ের ভেতরে ৩টি আন্ডারগ্রাউন্ড (ভূগর্ভস্থ) ওয়াটার রিজার্ভারে মজুত পানি পর্যাপ্ত ছিল না। সে কারণে দূরবর্তী স্থান ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন ও ফটকের বাইরে বিশেষ পানিবাহী গাড়ি থেকে অনেক হোজপাইপ লে-আউটের মাধ্যমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছে। এ ছাড়া ওয়াসার পানি সরবরাহ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবনের ৬, ৭, ৮ ও ৯ তলায় দ্রুতগতিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রথমে ষষ্ঠ তলায় আগুন নির্বাপণ করতে হয়েছে। পরে পর্যায়ক্রমে ৭ম, ৮ম ও ৯ম তলায় আগুন নির্বাপণে সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পৌনে ১২টায় নির্বাপণ সম্পন্ন হয়।
তদন্ত কমিটির পরবর্তী কার্যক্রম
তদন্ত কমিটির পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে বলা হয়েছে, আগুনের উৎপত্তিস্থল থেকে ৩০ ডিসেম্বর যেসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাউন্টার আইইডি ফিউশন সেন্টারের পরীক্ষাগারে বিভিন্ন বিস্ফোরক ডিটেকশন ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে। ঘটনা পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ৭ নম্বর ভবন এবং আশপাশের ভবনের সব সিসিটিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আগুনটি বৈদ্যুতিক উৎস থেকে শুরু হয়েছিল কি না, তা অধিকতর রূপে নিশ্চিত হওয়ার জন্য দগ্ধ বৈদ্যুতিক কেব্ল সেগমেন্ট, জয়েন্ট বক্স ও ব্রেকারগুলোর নমুনার ওপর এক্স-রে রেডিওগ্রাফ, মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা এবং পোড়া ইনসুলেটরের রাসায়নিক গঠনের জন্য ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম ইনফ্রারেড স্পেকট্রোস্কোপি করেও আগুনের কারণ সম্পর্কে সূত্র পাওয়া যেতে পারে। প্রাথমিক তদন্তে উদ্ঘাটিত বৈদ্যুতিক গোলযোগের (স্পার্ক) বিষয়টির সঙ্গে অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
বড়দিনের ছুটির দিন গত বুধবার গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে। এতে এই ভবনে থাকা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কক্ষগুলো পুড়ে যায়। দেয়াল ও মেঝেতেও বড় ক্ষতি হয়। ভবনটির ক্ষতিগ্রস্ত তলাগুলো আপাতত ব্যবহার করার সুযোগ নেই। এ জন্য অস্থায়ীভাবে বিকল্প অফিস করছে মন্ত্রণালয়গুলো।