বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিয়মিতভাবে ১ কোটি ৯৪ লাখ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এই হিসাব অনুযায়ী, এ অঞ্চলের জনসংখ্যার হিসাবে রক্তদাতার হার শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ। কোনো অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ৩ শতাংশ নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদান করলে নিরাপদ রক্তের প্রয়োজনীয়তা সহজেই পূরণ করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বিবেচনায় নিলে এই অঞ্চলে স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যায় ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা বাড়ছে না। সেই সঙ্গে নারী রক্তদাতার সংখ্যা পুরুষের তুলনায় কম। স্বেচ্ছা রক্তদানের হার বাড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি।
আজ ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিনির্ধারণী ফোরাম ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি ২০০৫ সালে ১৪ জুনকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর পর থেকে দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘রক্ত দান করুন, দান করুন প্লাজমা, যতবার সম্ভব জীবন বাঁচানোর এ সুযোগ গ্রহণ করুন’।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পুনম ক্ষেত্রপাল সিংহ এক বিবৃতিতে বলেছেন, যেকোনো দেশের যেকোনো অঞ্চলের যেকোনো সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য নিরাপদ রক্তের ঘাটতি মেনে নেওয়া যায় না। তিনি এই অঞ্চলের স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে যে নিরাপদ রক্তের ঘাটতি রয়েছে, তা পরিসংখ্যান থেকেও বোঝা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির তথ্য বলছে, দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগও জানিয়েছে, তাদের কাছে আসা রক্তদাতাদের ৩৪ শতাংশ স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে যান। বাকি রক্তের জোগান আসে রোগীর আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাংক থাকলে রক্তদাতাদেরও একটি ডেটাবেইস (তথ্যভান্ডার) গড়ে উঠত। তাহলে কোন রক্তের গ্রুপের কত মানুষ আছে, কোথায় আছে, তা সহজেই জানা যেত। মানুষের জন্য রক্ত সংগ্রহও সহজ হতো।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির পরামর্শক অধ্যাপক সৈয়দা মাসুমা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রক্তদানের জন্য অনেক ক্যাম্প হয়, কিন্তু আশানুরূপ হারে স্বেচ্ছা রক্তদাতা পাওয়া যায় না। স্বেচ্ছায় রক্তদানকেই উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য প্রচার দরকার। তারকারা যদি নিজ উদ্যোগে রক্ত দিতেন এবং তা মানুষকে জানাতেন, তাহলে অনেকেই আগ্রহী হতেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্থ মানুষের শরীরে অতিরিক্ত দেড় লিটার রক্ত থাকে। মানুষের শরীরে ১২০ দিন পর রক্ত ভেঙে যায়। অর্থাৎ এ রক্ত কোনো কাজে আসে না। তাই সুস্থ মানুষের নিয়মিত (১২০ দিনের চক্রে) রক্ত দেওয়া উচিত। যদিও দেশে রক্তদাতার সংখ্যার সঠিক হিসাব নেই। তেমনি নিয়মিত চাহিদা ঠিক কত এবং কী পরিমাণে রক্ত দেওয়া হচ্ছে, সেই তথ্যও জানা যায় না।
রক্তদানে নারীরা কেন পিছিয়ে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় তরুণেরা বেশি রক্ত দেন। বিশ্বে রক্তদাতাদের মধ্যে নারী মাত্র ৩৩ শতাংশ।
রক্তদানে বাংলাদেশেও নারীরা পিছিয়ে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচি থেকে জানা যায়, রক্তদাতাদের প্রায় ৮৫ শতাংশই পুরুষ।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে জানা যায়, গত ২৩ বছরে তাদের পুরুষ রক্তদাতার সংখ্যা ৪ লাখ ২৬ হাজার ১০৭। এর বিপরীতে নারী রক্ত দাতার সংখ্যা ৪৮ হাজার ৯১১।
নারী রক্তদাতা কম হওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তদানে শারীরিক গঠন, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা, ওজনের মতো বিষয় নির্ভর করে। এ ছাড়া গর্ভকালে, প্রসব–পরবর্তী সময় ও নারীরা দুগ্ধদানের সময় রক্ত দিতে পারেন না। পাশাপাশি পিরিয়ডের সময় মেয়েদের রক্ত না দিতে উৎসাহিত করা হয়। এসব কারণ ছাড়াও যেখানে রক্ত নেওয়া হয় সেখানকার পরিবেশ, নারীদের রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহের মতো সামাজিক কিছু বিষয়ও নারীদের রক্তদানে নিরুৎসাহিত করে।
তবে রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের সভাপতি নাহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দাতার প্রয়োজন হলে বাঁধন কখনো ছেলে বা মেয়ে বিবেচনা করে না। সবাইকেই ফোন দেওয়া হয়। তিনি বলেন, শুরুতে মেয়েদের অনেকে হয়তো একটু ভয় পান। কিন্তু একবার দেওয়ার পর সেই ভয় কেটে যায়। মেয়েদের মধ্যে রক্ত দেওয়ার আগ্রহও অনেক বলে জানান তিনি।
তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা প্রয়োজন
রক্তদানে আগ্রহী ও রক্তদাতাদের একটি সামগ্রিক তথ্যভান্ডার থাকলে স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচি আরও জোরদার করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির (ব্লাড ট্রান্সফিউশন) সহকারী অধ্যাপক আশরাফুল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাংক থাকলে রক্তদাতাদেরও একটি ডেটাবেইস (তথ্যভান্ডার) গড়ে উঠত। তাহলে কোন রক্তের গ্রুপের কত মানুষ আছে, কোথায় আছে, তা সহজেই জানা যেত। মানুষের জন্য রক্ত সংগ্রহও সহজ হতো।
স্বেচ্ছায় রক্তদাতা না বাড়া প্রসঙ্গে আশরাফুল হক বলেন, যাঁরা নিয়মিত রক্ত দিচ্ছেন, তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো ব্যবস্থা থাকলে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়ত।